ভিকারুননিসা : বেসরকারি, তাই যত অনিয়ম

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

দেশের সবচেয়ে নামীদামী কয়েকটি স্কুলের নাম জানতে চাইলে যে কেউ সর্বাগ্রে ঢাকা শহরের ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নাম বলবেন। কয়েক বছর আগেও এটি শুধু স্কুল ছিল। এখন স্কুলের সাথে কলেজ যোগ হয়েছে। হাজার হাজার ছাত্রী, শতশত শিক্ষক, মর্নিং শিফট, ডে শিফট মিলিয়ে একাধিক ক্যাম্পাস নিয়ে অভিজাত প্রতিষ্ঠানটি দেশের একটি নামকরা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অভিজাত এ জন্য যে, দেশের অভিজাত শ্রেণি, যাদের অঢেল টাকা পয়সা তারা সন্তানদের ভিকারুনিসায় ভর্তি করার জন্য একদম পাগল। লাখ লাখ টাকা ডোনেশন দিয়েও অনেকে সেখানে কন্যাকে ভর্তি করিয়ে থাকেন। একনামে সারাদেশে এর পরিচয়। কিন্তু এটি যে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ফি বছর পত্র-পত্রিকার শিরোনাম হয়, সেটি ক'জন মানুষের জানা? শিক্ষার্থী নির্যাতন, গলা কাটা ফি, কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, গভর্নিং বডির স্বেচ্ছাচারিতা, বিতর্কিত ও অদক্ষদের অধ্যক্ষ পদে বসানো এবং আর্থিক কেলেংকারি ইত্যাদি নানা কারণে প্রায় প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানটি ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ হয়।

রাজধানী শহর ঢাকায় অবস্থিত দেশের সেরা এই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণ প্রতিটি শহর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো প্রায় এক ও অভিন্ন। একমাত্র ব্যবস্থাপনাগত কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘুরে-ফিরে প্রায় অভিন্ন রকমের অনিয়ম ঘটে থাকে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ জাতীয় অনিয়ম সচরাচর কম ঘটে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শাস্তিমূলক বদলির ভয় থাকে, বরখাস্ত হবার আশঙ্কা থাকে, চাকরি হারানোর উৎকন্ঠা থাকে, ইনক্রিমেন্ট কর্তন হওয়ার ডর থাকে, কমিটি-খামিটি থাকে না, ছোট্ট পরিসরের একটা একাডেমিক কাউন্সিল থাকে, সরকারি বলে সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান থাকে। অন্যদিকে, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট চাকুরিবিধি নেই। চাকুরিতে ঝুঁকি নেই বললেই চলে। কমিটি অল ইন অল। ফেভারে থাকলে সাত খুন মাফ! এ সুযোগে ভিকারুননিসার কথা বলি আর অন্য যে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কথাই বলি, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির ক্ষেত্র অটোমেটিক সৃষ্টি হয়ে যায়।

ছাত্রী ধর্ষণের মতো ঘটনা কোনো শিক্ষকের দ্বারা যখন সংঘটিত হয়, তখন সে শিক্ষকের কোনো নৈতিকতা নেই বলে ধরে নেয়া স্বাভাবিক। এসব অনৈতিক মানুষগুলো শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় আসে কী করে? এমন একটি প্রশ্ন যে কারো মনে বার বার ঘুরপাক খেতে থাকে। আসলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এরকম সুযোগ থেকে থাকে। প্রথমত,আজকাল মেধাবী ও প্রখর নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিরা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে তেমন আগ্রহী না। এমনিতেও শিক্ষকতা আজকাল খুব কম লোকের পছন্দ। তারচেয়ে আনসার কিংবা পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি অনেকের পছন্দের তালিকায় স্থান পেয়ে বসে।

বেসরকারি স্কুল কিংবা কলেজ হলে আর কথা নেই। কেবল যারা অন্য কোথাও কর্ম বাগিয়ে নিতে পারে না, চাকরিতে প্রবেশের বয়স এক রকম প্রায় শেষ, তারাই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে ছুটে আসেন। ইদানিং এনটিআরসিএর হাতে নিয়োগ কার্যক্রম চলে যাবার পর কিছু মেধাবী মুখ শিক্ষকতা পেশায় আসার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে বটে। প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সহকারী প্রধান নিয়োগে এখনো সেই বদি খাঁর আমলের নিয়ম বহাল আছে। তাই এক্ষেত্রে কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বিবেচিত হয়। কত জায়গায় কমিটি টাকা খেয়ে তাদের ইচ্ছেমতো প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সহকারী প্রধান নিয়োগ দিয়ে থাকে। এরকম মাটির পুতুল মার্কা প্রতিষ্ঠান প্রধান ও কমিটির লোকজন মিলে কত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লুটেপুটে খাচ্ছে।

ইদানিং এক শ্রেণির শিক্ষক নোট গাইডের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে। বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা কিংবা পুস্তক ব্যবসায়ীরা এসব শিক্ষকদের বখরা দিয়ে থাকে। বখরা পেয়ে তারা যতসব পঁচা নোট গাইড ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেবার হীন প্রয়াস চালায়। এসব অনৈতিক কাজ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক শ্রেণির শিক্ষক নামধারী ব্যক্তিরা করে থাকে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে এ প্রবণতা তেমন একটা দেখা যায় না। এ জন্য খালি খালি বেসরকারি শিক্ষকদের দোষ দেই কী করে? সামান্য বেতন বলেই তারা ভিন্ন পথে আয়ের সংস্থান খোঁজেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন অনেককে জানি, যারা নোট গাইডের প্রকাশক কিংবা পুস্তক ব্যবসায়ীর কাছে থেকে টাকা নেবার জন্য তাদের পেছনে ঘুরঘুর করেন। এদের কারণে গোটা শিক্ষক সমাজের মুখ ছোট হয়ে থাকে।

আমি একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা জানি, যেখানে এক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হবার জন্য প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন। মামলাটি আজ প্রায় নয়-দশ বছর ধরে চলমান। আরও ক’বছর চলে, কে জানে? এভাবে দেশে শত শত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দাতা, প্রতিষ্ঠাতা কিংবা কমিটি গঠনসংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে আছে। কোনো সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এরকম মামলা মোকদ্দমার কথা কোনোদিন শুনিনি।

যে যাই বলি না কেন, বেসরকারি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিযোগিতামূলকভাবে কোচিং ক্লাস চলে থাকে। স্কুল পর্যায়ে বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষকের মধ্যে কোচিং নিয়ে দলাদলি পর্যন্ত হয়। প্রত্যেকে নিজের কোচিং ক্লাসে শিক্ষার্থী বাড়ানোর জন্য নানা হীন পথ অবলম্বন করে থাকেন। কোথাও ছাত্ররা মারামারি করে আবার কোথাও এ নিয়ে শিক্ষকরাও হাতাহাতি করেন বলে শোনা যায়। ইংরেজির শিক্ষকও কম যান না। কলেজ পর্যায়ে তো ইংরেজি শিক্ষকের একচেটিয়া বাজার। এই কোচিং বাণিজ্যের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারিকরণের বিকল্প কোনো পথ নেই। ভিকারুননিসার মতো বড় বড় নামীদামী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই নোট-গাইড কোচিং বাণিজ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন বলে অনেকে মনে করে থাকেন।

আমাদের দেশে যে দুটি পেশার মানুষজন সবচেয়ে বেশি মানবিক হবার কথা। একটি শিক্ষক, অপরটি ডাক্তার। সেই শিক্ষক ও ডাক্তারদের কেউ কেউ কত যে অমানবিক, তা কোচিং সেন্টার ও ডায়গনস্টিক সেন্টারগুলোর দিকে তাকালে সহজে আন্দাজ করা যায়। সপ্তাহে তিনদিন পড়িয়ে বার দিনে মাস গুণে দেড়-দু’হাজার টাকা কোচিং ফি যারা আদায় করে, তারা কোন জাতের শিক্ষক? অনুরূপ রোগীর সাথে দু’-চার কথা বলেই টেস্ট করবার জন্য রোগীকে একটা স্লিপ দিয়ে ডায়গনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে দিলে ডাক্তারকে কসাই না বলে কী বলা যায়? যারা মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করে তাদের ওপর পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা না করলে জাতি একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে।

আজ যেটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা। শিক্ষায় আমরা অনেক এগিয়েছি। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষায় আমরা আজও পিছিয়ে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য স্কুল-কলেজ সরকারিকরণ ছাড়া কোন পথ দেখি না। স্কুল কলেজে দালান নির্মাণে আমাদের মনযোগ বেশি বলে মনে হয়। তারচেয়ে আমাদের বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে মনযোগী হতে হবে। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় টেনে আনতে না পারলে সবই বিফলে যাবে। একমাত্র সরকারিকরণের মাধ্যমে মেধাবী তরুণদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা যেতে পারে।

লেখক : চড়িপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোজায় স্কুল: শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম, নজরদারিও ঢিলেঢালা - dainik shiksha রোজায় স্কুল: শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম, নজরদারিও ঢিলেঢালা পেনশন প্রজ্ঞাপনে উদ্বিগ্ন ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha পেনশন প্রজ্ঞাপনে উদ্বিগ্ন ঢাবি উপাচার্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুদান করমুক্ত - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুদান করমুক্ত ব্রাজিলে তীব্র গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ - dainik shiksha ব্রাজিলে তীব্র গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের নামে প্রতারণা, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের নামে প্রতারণা, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পেলো ‘হেট’ - dainik shiksha উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পেলো ‘হেট’ আটকের ১৩ দিন পরেও বরখাস্ত হননি অধ্যক্ষ - dainik shiksha আটকের ১৩ দিন পরেও বরখাস্ত হননি অধ্যক্ষ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025219917297363