ভিসি পদ এবং শিক্ষাব্যবস্থা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

এক সময় দেশে যাত্রাপালার ব্যাপক প্রচলন ছিল। মানুষ তখন যাত্রা দেখতো, যাত্রাগুলো ছিল রাজরাজাদের যুদ্ধবাজ কাহিনী নিয়ে। এরকম একটি যাত্রাপালার এক সামন্ত ভিলেন রাজার ডায়লাগ ছিল- আমি মহাস্থানগড়ের মানুষ চাই না, আমি চাই শুধু মাটি। অর্থাৎ এই ডায়ালগের মাধ্যমে রাজা বোঝাতে চেয়েছিলেন, তিনি মহাস্থানগড়টি তার দখলে চান এর জন্য যত মানুষ বা সম্পদ ধ্বংস হোক না কেন তাতে তার কোন আসে যায় না। তার দখল করা রাজ্যটিতে কোন মানুষ বা সম্পদ না থাকলে তার কোন ক্ষতি নেই শুধু তার রাজত্ব বহাল থাকলেই হলো। আধুনিক সভ্যসমাজে দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আচরণে সেই সময়কার সামন্ত রাজার মনোবৃত্তির প্রতিফলনটাই দেখা যায়। গত এক বছর যাবৎ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে উপাচার্যের কর্মকা- নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সরকার কর্তৃক উন্নয়ন বরাদ্দ পাস হওয়ার পর শুরু হয়ে যায় নানা রুপের নানা রকমের আন্দোলন। তাহলে কি সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থই এই আন্দোলনের মূল কারণ। এতে প্রমাণ হয় দেশের উচ্চশিক্ষালয়ের কর্ণধাররা অর্থ লোপাটের অংশে ভাগ বসাতে কাড়াকাড়ি করছেন। যদি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ ধরনের চেহারাটা ফুটে উঠে তাহলে অন্যসব প্রতিষ্ঠানগুলো যে দুর্নীতির রাহুগ্রাসে আক্রান্ত তা সহজেই অনুমান করা যায়। বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, দেশের নয়াভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। গত এক বছর আগে কয়েকশ’ গাছ কাটা হয়, যা সামগ্রিকভাবে পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক একটি বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে পরিবেশবিদরা। তখনই পরিবেশ রক্ষায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতে মাঠে নামেন। আর পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বেরিয়ে আসে থলের ভিতর অবস্থান করা আরেক দুর্নীতির বিড়াল। অভিযোগ উঠে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের চাঁদা আদায়ের বিষয়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই কোটি টাকা চাঁদা নেয়ার কথা শুনা যায় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদক সম্পর্কে। এ ধরনের নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সম্পাদককে পদচ্যুত করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামীগ প্রধান। অভিযোগ উঠে ফারজানা ইসলামের স্বামীর বিরুদ্ধেও তিনি তার স্ত্রীর ক্ষমতাকে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করেন। ভিসির স্বামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ির ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করার কথাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুনা যায়। ক্যাম্পাসে কথিত আছে যে, ভিসি এবং তার পরিবার মিলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন পরিচালনা করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। গত কয়েক দিন আগে ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলন থামাতে আন্দোলনরতদের ওপর হামলা চালায় ভিসিপন্থীরা। এ হামলায় কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ভিসিপন্থীদের হাতে লাঞ্ছিত হন। ভিসির পক্ষ এবং বিপক্ষের সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় অনিদির্ষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অনিদির্ষ্টকালের বন্ধ ঘোষণার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয় কতৃপক্ষ। কিস্তু শিক্ষাথীরা সেই নির্দেশ অমান্য করে ক্যাম্পাসে অবস্থান করেন, বিভিন্ন হলের তালা ভেঙে তারা হলেই অবস্থান করে। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট অব্যাহত রাখে। কার্যদেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠটির শিক্ষা কার্যক্রম অচল হয়ে পড়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর চলা অচলাবস্থার নিরসন কেন হলো না, এর কোন সুনিদির্ষ্ট জবাব পাওয়া যায় না। তাহলে এর দায় কার?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিচালিত। এই অধ্যাদেশ অনুসারে এই বিদ্যাপীঠের আচার্য্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। এ পরিচালনা পর্ষদের ব্যক্তিরা এক বছরে এই অচলায়তন কাটানোর জন্য কি কি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তাও দেশবাসীকে জানানোর প্রয়োজন। সরকারি মহল এবং ভিসি মনে করেন ভিসির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো সত্য নয়। তাহলে কেন ছাত্র শিক্ষকদের বড় অংশ ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে? যদি আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থের বাইরে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশে অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের পদত্যাগ চান, সেই বিষয়টিও ভিসিপন্থীদের গণমাধ্যমে প্রকাশ করা দরকার। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কোন নদীতে জেগে ওঠা চর বা ভূমি নয়, যে কেউ তা গায়ের জোরে দখল করে নেবে। সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে যে আন্দোলন চলছে তা ভিসিকে কেন্দ্র করেই। প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীদের মূল দাবি ভিসির পদত্যাগ। কেন ভিসিরা পদত্যাগ করবেন তার কারণ হিসাবে আন্দোলনকারীরা বলছেন ভিসিরা দুর্নীতিগ্রস্ত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য যে পরিচালনা পর্ষদ (সিনেট) গঠিত হয়েছে তা কি ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশটি অনুসারে হয়েছে কিনা, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যারও প্রয়োজন। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের স্বায়ত্তশাসনের নামে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতটুকু পরিচালিত হচ্ছে। তা নিরূপণ করা দরকার, যদি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যায় পরিচালনার ক্ষেত্রে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশটি পাশ কাটিয়ে কোন কিছু করা হয়ে থাকে তাহলে সেই বিষয়গুলোর দায় ভার কে নেবে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জনগণের করের টাকায় পরিচালিত হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা সাধারণ মানুষেরই সন্তান। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানার বিষয়টি যদি চিন্তা করা হয় তাহলে এ দেশের সাধারণ মানুষই এই বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মালিক। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যায়েরর পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের প্রতিনিধিত্ব কতটুকু আছে? সরকারের পক্ষ থেকে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন থামানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হচ্ছে কিন্তু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার পরিচালনা পর্ষদের ভূমিকা কি? তারা কেন নীরব?

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় বিষয়গুলো যদি সরকারকেই দেখভাল করতে হয় তাহলে নামে মাত্র স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি থাকা আদৌ কী প্রয়োজন রয়েছে? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান আন্দোলনের চাপে যদি ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম পদত্যাগ করেন, তাহলে কি সরকারের কোন প্রকার ক্ষতি হবে? ফারজানা ইসলামের পদত্যাগের কারণে সরকারের নৈতিক বা রাজনৈতিক কোন রকমেরই পরাজয় ঘটবে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের নীতি গর্হিতভাবে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এই দুর্নীতির কথাটি দেশেবাসী জানে। তাহলে এখন প্রশ্ন করা যাবে কি এই অনিয়মের সঙ্গে ভিসি জড়িত ছিলেন না। ধরে নেয়া যাক তিনি কোন অর্থ নিজের জন্য তছরূপ করেন নাই বা নিজে হাতিয়ে নেন নাই। তারপরও বলা যাবে যে, তারই আমলেই নিয়মবহির্ভূতভাবে ঈদ সেলামিসহ বিরাট অংকের টাকা ঘুষ হিসেবে লেনদেন হয়; যা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এ ধরনের লেনদেন একটি কলংকময় অধ্যায়। কারণ তিনি এই আর্থিক দুর্নীতিটি বন্ধ করতে পারেনি। তাই নিজের এই অপারগতা বা ব্যর্থতার বিষয়টি তিনি যদি আমলে নিয়ে পদত্যাগ করেন, তাহলে কি তিনি হেরে যাবেন। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাবিদদের উদার মানসিকতার ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়া উচিত তাদের গোয়ার্তুমি মানসিকতা থাকাটা ঠিক না। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের পদত্যাগ করাটাই জরুরি। ধরে নিলাম তিনি কোন অনিয়ম বা দুর্নীতি করেন নাই তারপরও হাজার হাজার শিক্ষার্থীর কথা বিবেচনায় নিয়ে তার উচিত এই পদত্যাগ থেকে সরে দাঁড়ানো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অচলায়তন সৃষ্টি হয়েছে তা পেশিশক্তি দ্বারা প্রশমন করলে তারও ফল ভালো হবে না।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম এবং দুর্নীতির কথাগুলো যখন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। তা দেখে বোঝা যায় দেশের শিক্ষাবিদদের নৈতিক চরিত্রের কতটা অধঃপতন ঘটেছে। এ ধরনের নৈতিকতার অধিকারীরা কখনো নৈতিক মানবসম্পদ তৈরি করতে পারবে না। শিক্ষাবিদের এই নৈতিক স্খলনে বোঝা যায়, দেশের ভবিষ্যতও অন্ধকার।

দেশের ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ এবং পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য প্রণীত ভিন্ন ভিন্ন অধ্যাদেশগুলোর সমন্বয় করা প্রয়োজন। দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যায়গুলো একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে পরিচালনা করলে আজকের এই উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টি অনেক ক্ষেত্রেই হতো না। যেহেতু দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে তাই ইউজিসিকেও ঢেলে সাজানো দরকার। ইউজিসির মাধ্যমে সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যকলাপ পরিচালনা করা প্রয়োজন। কারণ স্বায়ত্তশাসনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক শিক্ষার্থীরাও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসনের অধীন পরিচালনার ক্ষেত্রে বারবার ব্যর্থতারই পরিচয় দিচ্ছে। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট নিরসনে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। সুতরাং সময় এসেছে নতুন করে ভাববার। তাই সরকারের উচিত দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য নতুন একটি আইন প্রণয়ন করার।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলামিস্ট, ৩২৫ কাদিরগঞ্জ দরিখোরবোনা, রাজশাহী


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0021991729736328