মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের কর্মচারী আতিকের এত সম্পদ!

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

রাজধানীর নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ওই প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আতিকুর রহমান খান ‘ইঞ্জিনিয়ার আতিক’ হিসেবে পরিচিত। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনে টেকনিশিয়ান হিসেবে ওই স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এখন বেতন পান প্রায় ২৫ হাজার টাকা। একজন কর্মচারী হয়েও চাকরিজীবনের ১৫ বছরে হয়েছেন অঢেল সম্পদের মালিক। শনিবার (১৯ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানে অবৈধ ভর্তিসহ সব বাণিজ্যের হোতা এই আতিক। তিনটি ক্যাম্পাসের প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর ড্রেস (পোশাক), ক্যান্টিন, লাইব্রেরি সবই বেনামে তাঁর নিয়ন্ত্রণে। এমনকি স্কুলের সামনে ফুটপাতে শতাধিক দোকান বসিয়েও তিনি আয় করেন মোটা অঙ্কের টাকা। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানে যত ধরনের কেনাকাটা, উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ হয় তার সবই করেন আতিক। দরপত্রেও অংশ নেয় নামে-বেনামে তাঁরই প্রতিষ্ঠান। সেখানে চলে বড় ধরনের লুটপাট। গত ১২ বছরে প্রতিষ্ঠানে পাঁচ শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বেশির ভাগ শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং কর্মচারী নিয়োগে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে। এর বেশির ভাগই হয়েছে আতিকের মাধ্যমে।

জানা যায়, স্কুলের মতিঝিল শাখায় শিক্ষকদের বসার স্থান সংকুলান না হলেও আতিকের জন্য আছে এসি লাগানো বড় কক্ষ। এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের জনবল কাঠামোতে শিক্ষক ও কর্মচারী ছাড়া আর কোনো পদ নেই। তবে আতিক বর্তমানে ‘সহকারী ইঞ্জিনিয়ার’ পদের বেতন নিচ্ছেন। যদিও এ ধরনের কোনো পদই জনবল কাঠামোতে নেই। আতিকের বিষয়ে অধ্যক্ষ সব জেনেও না জানার ভান করেন। গভর্নিং বডির বর্তমান সভাপতি সরকারের যুগ্ম সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানও নিশ্চুপ।

প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ার আতিকের স্কুলে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। তবে স্কুলের কাজকর্ম দেখে। স্কুলে তার কোনো রুম নেই। তবে একটি রুমে টেন্ডারসংক্রান্ত জিনিসপত্র রাখা হয়, সেখানে আতিকসহ নির্মাণসংক্রান্ত কমিটির লোকজন বসেন।’

অধ্যক্ষ আরও বলেন, ‘আতিকের শ্বশুরের দুটো মেয়ে। তাদের বহু জায়গাজমি দিছে, যা আমার জানার ব্যাপার না। আতিকের বাবারও অনেক প্রপার্টিজ ছিল। চেষ্টা করলে সেগুলোও বাড়তে পারে।’

জানা যায়, আইডিয়ালের তিন শাখায় প্রতিবছরই হাজারখানেক শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় অবৈধভাবে। ওই ধরনের ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নেয়া হয় দুই থেকে তিন লাখ টাকা। আর এই টাকার পুরোটাই লেনদেন হয় আতিকের হাত দিয়ে। তবে গত বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাপে ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। ভর্তি পরীক্ষার উত্তরপত্রে ঘষামাজা করে অবশ্য ধরাও পড়ে যান আতিকসহ ছয়জন। ঘষামাজা করে নতুনভাবে লিখে অবৈধভাবে ভর্তি করার বিষয়টি প্রমাণিত হয় ঢাকা জেলা প্রশাসনের তদন্তে। ওই জালিয়াতিতে জড়িত হিসেবে আতিকসহ ছয়জনের নাম উঠে আসে তদন্তে। এতে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের এমপিও কেন বন্ধ হবে না সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় কারণ দর্শানোর নোটিশও দিয়েছে এরই মধ্যে।

একজন অভিভাবক এ বছর তিন লাখ টাকা দিয়ে তাঁর সন্তানকে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছেন মতিঝিল শাখায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমার কথা হয়েছে মতিঝিল শাখার একজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁর কথামতোই শান্তিনগর এলাকার একটা দোকানে আমি টাকা দিয়ে আসি। আমাকে বলা হয়েছিল, পরীক্ষার খাতায় কিছু না লিখলেও চলবে। সেই অনুযায়ী প্রথম দুই পৃষ্ঠা লিখে বাকিটা খালি রেখে এসেছে। এরপর দেখলাম আমার ছেলের রোল নম্বর প্রথম দিকেই রয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন অভিভাবক বলেন, ‘গত বছর আমার বাচ্চাকে বনশ্রী শাখায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছি। কথা হয়েছে মতিঝিল শাখার একজনের সঙ্গে। বনশ্রীর একটা ফার্মেসিতে (ওষুধের দোকান) তিন লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে এসেছিলাম। এরপর ভর্তি করে নিয়েছে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, আতিক নিজে চলাফেরা করেন একটি দামি নোয়া গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো চ-১৫-১৩৪৮)। স্কুলে বই পাঠ্য করে কমিশন বাণিজ্য এবং নিজের টেইলার্স দোকান থেকে পোশাক বানাতে বাধ্য করেন তিনি। আশিক ও বিশ্বাস লাইব্রেরি এবং আইডিয়াল স্কুলের প্রতিটি ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনও বেনামে তিনিই চালান। বনশ্রীর ‘ডি’ ব্লকের ১০ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় থাকেন নিজের এক হাজার ৬০০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাটে। আফতাবনগর ‘বি’ ব্লকের ৩৪ নম্বর বাড়িটি তাঁর স্ত্রীর নামে। বনশ্রীর ‘সি’ ব্লকের ১ নম্বর রোডের ৩৩ নম্বর বাড়িতে বিশাল শোরুম ভাড়া দিয়েছেন। ওই এলাকায় আছে একাধিক দোকান। ভিশন-৭১ নামে আছে ‘ডেভেলপমেন্ট কম্পানি’। বনশ্রীর ‘সি’ ব্লকের ১৩ নম্বর রোডে তাঁরই কম্পানি থেকে তৈরি করা বাড়িতে আছে একাধিক ফ্ল্যাট। মেরুল বাড্ডার আনন্দনগর হাজী ওয়াকিল উদ্দিন সড়কের ১ নম্বর রোডের ৭৪৭ নম্বর বাড়িটি আতিকের শ্বশুরের। তাঁর টাকায় সেখানে উঠেছে সাততলা ভবন। গাজীপুরের কালীগঞ্জে প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে তিনি গড়ে তুলেছেন বাগানবাড়ি ও পিকনিক স্পট। একাধিক মাল্টিপারপাস সমিতির মালিকানা আছে তাঁর। সেখানে নিজের অবৈধ টাকা খাটান তিনি। সম্প্রতি তাঁর ভিশন-৭১ ডেভেলপমেন্ট কম্পানির নৌবিহারে উপস্থিত ছিলেন স্কুলের অধ্যক্ষও।

অভিযোগ আছে, স্কুলের প্রভাবশালী এক শিক্ষকের ছেলে, যিনি প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন, তিনিও আতিকের ডেভেলপমেন্ট কম্পানির ব্যাবসায়িক অংশীদার।

জানা যায়, স্কুলের সামনে ফুটপাতে এবং পাশের এজিবি কলোনিতে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে শতাধিক অবৈধ দোকান নিয়ন্ত্রণ করেন আতিক। তাঁর ওই কাজের সহযোগী হলেন প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির এক সদস্য। ওই সদস্য মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা এবং একটি আলোচিত হত্যা মামলার আসামি।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আতিকুর রহমান খান বলেন, ‘আমি চাকরি শুরুর আগে থেকেই ব্যবসা করি। আমার চার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণও রয়েছে। কালীগঞ্জে আমি পৈতৃক সূত্রেই ১৫ বিঘা জমি পেয়েছি। তবে একটি চক্র আমার নামে অপপ্রচার করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি তো ভর্তি কমিটিতে নেই, তাহলে আমি কীভাবে বাণিজ্য করব? আর আমি যদি বাণিজ্য করি, তাহলে স্কুলের সবাই বাণিজ্য করে।’ তবে তিনি প্রতিবেদনটি প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন বারবার।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032708644866943