মাছ বাজারের ঘুপচির স্কুলও এমপিওভুক্ত!

নিজস্ব প্রতিবেদক |

রাজধানীর শ্যামলীতে মাছ বাজারের ওপর পরিচালিত ‘শ্যামলী পাবলিক স্কুল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত  করা হয়েছে। বাজারের একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় আবাসনের পাশে বিদ্যালয়টি গড়ে তোলা হয়েছে। এমপিওভুক্তির নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ধরনের যোগ্যতা না থাকলেও অসাধু পন্থায় প্রতিষ্ঠানটিকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে বলে দাবি শিক্ষক নেতাদের।

সোমবার (৯ ডিসেম্বর) শ্যামলীর আদাবরের শেখেরটেক ৭ নম্বর রোডে ‘শ্যামলী পাবলিক স্কুল’-এ গিয়ে দেখা যায়, আদাবর মাছ বাজারের প্রবেশপথে চারপাশে নোংরা পরিবেশ। বাজার সংলগ্ন অন্ধকারাচ্ছন্ন সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় গড়ে উঠেছে ‘শ্যামলী পাবলিক স্কুল’।

কিন্ডারগার্টেনের আলোকে তৈরি করা এ স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে এসএসসি ও এসএসসি ভোকেশনাল কোর্স করানো হচ্ছে। স্কুলের ভেতরে চারটি ক্লাস রুম রয়েছে। ছোট একটি রুমে প্রধান শিক্ষক বসেন। স্কুলে প্রায় ১০ জন শিক্ষক রয়েছেন। তবে তাদের কেউই এনটিআরসিএ’র (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) সনদধারী নন। স্কুলের একটি ক্লাসে দুই জন ও অন্য আরেকটি ক্লাসে তিন জন শিক্ষার্থীর দেখা মেলে।

নীতিমালা অনুযায়ী, চার শর্ত পূরণ করলে একটি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হতে পারে। শর্তগুলো হল- প্রতিষ্ঠানের বয়স বা স্বীকৃতির মেয়াদ, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ও পাসের হার। স্বীকৃতির একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব ভূমিতে পরিচালনা করতে হয়।

নিজস্ব ভবনসহ এমপিওভুক্তির কোনো যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ‘শ্যামলী পাবলিক স্কুল’কে মাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিওভুক্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্যামলী পাবলিক স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক আব্দুল বাতেন দীর্ঘদিন স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ২০০২ সালে আদাবর বাজারের দ্বিতীয় তলার আবাসিক একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে কিন্ডারগার্টেন চালু করেন তিনি। অনুমোদন ছাড়াই সেখানে প্রথম শ্রেণি থেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়ানো শুরু করা হয়। পার্শ্ববর্তী একটি বিদ্যালয়ের মাধ্যমে ফরম পূরণ করানো হয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক সমাপনী ও এসএসসি পরীক্ষার। ২০০৫ সালে এখানে এসএসসি ভোকেশনাল কোর্স চালু করা হয়। কিছুদিন পর সেটির অনুমোদনও মিলে যায়।


জানা গেছে, ভোকেশনাল কোর্সের অনুমোদন পাওয়ার পর ২০১৮ সালের মাঝামাঝি এসএসসি ভোকেশনাল কোর্সের স্বীকৃতি দেয় কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। এরপর অবৈধভাবে বেড়িবাঁধ চন্দ্রিমা উদ্যানের পাশে ৯ নম্বর রোডের ১১ নম্বর বাড়িতে এবং সিঙ্গাইর বাসস্ট্যান্ডে ‘শ্যামলী পাবলিক স্কুল’র দুটি ব্র্যাঞ্চ করেন আব্দুল বাতেন। তবে সেখানে শিক্ষার্থী না আসায় এখন সেসব বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক আব্দুল বাতেনকে।

আব্দুল বাতেন বলেন, ‘অনেক কষ্টে প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে আসছি, ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার মতো আয় হয় না বলে পার্শ্ববর্তী কয়েকজন ভাবীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সকলে মিলে প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘এ প্রতিষ্ঠানে শুধু ভোকেশনাল কোর্সের অনুমোদন রয়েছে। ২০১৮ সালে এ পর্যায়ের স্বীকৃতি দিয়েছে কারিগরি শিক্ষাবোর্ড। চলতি বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুল মুকিত মজুমদারের সহায়তায় এ প্রতিষ্ঠানটিকে এমপিওভুক্ত করা হয়।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থি আমলারা এমপিওভুক্তির কার্যক্রমকে বিতর্কিত করছেন অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, ‘তালিকা চূড়ান্ত করার আগে শিক্ষক সংগঠনগুলোর সহযোগিতা নেয়া যেতো। আর এ কাজটি তো মাউশির (মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা অধিদফতর)। মাউশি’কে কেন বাদ রাখা হয়েছিল-বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিৎ।’

গত ২৪ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এবারের এমপিওভুক্তি নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। তাছাড়া ভুয়া প্রতিষ্ঠান বাদ দেয়া ও যোগ্য প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য সম্প্রতি এমপিরা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আধা সরকারিপত্র (ডিও লেটার) দিয়েছেন।


প্রসঙ্গত, শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২৩ অক্টোবর দুই হাজার ৭৩০টি প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির তালিকা প্রকাশ করে, যার মধ্যে মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান এক হাজার ৭৬টি। এই তালিকা প্রকাশের পর বিভিন্ন মহলে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। কারণ তালিকায় স্থান পায় প্রায় অস্তিত্বহীন ও যুদ্ধাপরাধীর নামে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান, জাতীয়করণ হওয়া প্রতিষ্ঠান, আংশিক এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান, স্বীকৃতিবিহীন এবং ভাড়া-বাড়িতে পরিচালিত ও ট্রাস্ট পরিচালিত অসংখ্য প্রতিষ্ঠান।

আবার অনেক প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে, যেগুলোতে এনটিআরসিএ সনদধারী কোনো শিক্ষকই নেই। কিছু প্রতিষ্ঠানে আদৌ কোনো শিক্ষার্থী রয়েছে কি-না, নাকি ভুয়া শিক্ষার্থী দেখিয়ে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে- তা নিয়েও বিতর্ক চলছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, এমপিওভুক্তির তালিকা প্রকাশের পর তীব্র সমালোচনার মুখে পুরো তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গত ১৩ নভেম্বর একটি কমিটি এবং ১৪ নভেম্বর আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে এক হাজার ৬৫০টি স্কুল ও কলেজের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মাউশি মহাপরিচালক প্রফেসর সৈয়দ মো. গোলাম ফারুকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কমিটিকে ২০ কর্মদিবসের মধ্যে এমপিওভুক্তির তালিকার যথার্থতা যাচাই করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। এ কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে মাউশি উপ-পরিচালক (মাধ্যমিক)। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন প্রতিনিধিকেও রাখা হয়েছে কমিটিতে।

স্কুল ও কলেজের তথ্য যাচাই কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। গত ৪ ডিসেম্বর থেকে এ কমিটি তালিকাভুক্ত সবক’টি স্কুল ও কলেজের প্রধানকে পর্যায়ক্রমে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে তথ্য-প্রমাণ নিয়ে হাজির হতে বলেছে। আগামী ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান প্রধানদের হাজির হতে হবে।

এদিকে নতুন এমপিওভুক্ত হওয়া এক হাজার ৭৬টি মাদ্রাসা, কারিগরি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা কলেজের তথ্য যাচাই-বাছাই শুরু হবে আগামী ১৮ ডিসেম্বর। চলবে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এমপিওভুক্তির তালিকায় স্থান পাওয়া মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাইয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। পাশাপাশি সদ্য এমপিওভুক্ত মাদ্রাসার তথ্য যাচাইয়ে ২টি ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাইয়ে ২টিসহ মোট ৪টি সাব-কমিটি গঠন করা হচ্ছে।

গত ১৪ নভেম্বর নতুন এমপিওভুক্ত মাদ্রাসা, কারিগরি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা কলেজগুলোর তথ্য যাচাই-বাছাই করতে ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয় কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) রওনক মাহমুদকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এমপিওভুক্তির জন্য নির্বাচিত এক হাজার ৭৬টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাইয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর ও বোর্ড, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর ও বোর্ড এবং ব্যানবেইসের (বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো) প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে চারটি সাব-কমিটি গঠন করা হবে। তারা তথ্য যাচাই-বাছাই করবে। আগামী ১৮ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট পাঁচ দিন নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য যাচাই-বাছাই করা হবে।

তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের সময়সূচি কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর ও বোর্ড, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর ও বোর্ড, জেলা প্রশাসক ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে জানিয়ে দেয়া হবে। কমিটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাই করে এমপিওভুক্তির যথার্থতা নিরূপণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘এমপিওভুক্তি সংক্রান্ত অনেক ভুল-ভ্রান্তির সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। এসব বিষয়ে যাচাই-বাছাই করতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি দেখছেন।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037000179290771