মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা নয়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ছাত্র রাজনীতি বন্ধ সমস্যার সমাধান নয়। বরং বলব, সত্যিকারের ছাত্র রাজনীতি না থাকায়ই আজকের এই অবস্থা। পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনে ছাত্র রাজনীতি উন্মুক্ত হোক, প্রসারিত হোক, স্বাধীন হোক। বন্ধ হোক লেজুড়বৃত্তি। এই লেজুড়বৃত্তিই সব সর্বনাশের কারণ। ছাত্র রাজনীতি টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি বহুবিধ দুস্কর্মের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কারণও এই লেজুড়বৃত্তিই। প্রকৃত ছাত্র রাজনীতি থাকলে আজ আবরারকে এভাবে পৈশাচিকতার শিকার হতে হতো না আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড এবং তৎপরবর্তী পরিস্থিতি শুধু ছাত্র রাজনীতিই নয়; সমাজ, জাতীয় রাজনীতি ইত্যাদি সবকিছুর জন্যই একটি কঠিন সতর্কবার্তা মনে করি। অনস্বীকার্য যে, এ দেশের ছাত্র রাজনীতির অর্জন কম নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, স্বাধীনতার পূর্বকালে এমনকি স্বাধীনতা-উত্তরকালেও এ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ছাত্র রাজনীতি ব্যাপক অবদান রেখেছে। ছাত্র রাজনীতির অঙ্গন থেকেই এ দেশের অনেক নেতা তৈরি হয়েছেন, যারা জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে সমুজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন ও করছেন। কিন্তু সেই ছাত্র রাজনীতি আর বর্তমানের ছাত্র রাজনীতি এক নয়। আমরাও ছাত্র রাজনীতি করেছি; কিন্তু সেই রাজনীতি লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি ছিল না। রাজনৈতিক দলের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপট সত্যিকার অর্থেই ভিন্ন। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হওয়ার বিষয় নয়। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির নামে যে অপরাজনীতি চলছে, তা বন্ধ হওয়া উচিত এবং এটি করতে হবে কালক্ষেপণ না করে। জাতীয় পর্যায়ে যেখানে খুন, গুমসহ নানারকম অনাকাঙ্ক্ষিত ও উদ্বেগজনক কর্মকাণ্ড চলছে, এর অপচ্ছায়া সমাজের নানা ক্ষেত্রে, নানা স্তরে পড়েছে। ছাত্র রাজনীতিও এর বাইরে নয়। আমরা যখন ছাত্র রাজনীতি করেছি, তখন ছাত্রদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের হীন স্বার্থবাদিতার কোনো সংযোগ ছিল না। কিন্তু আজ যা চলছে এর অবসান হওয়া দরকার। আমরা অতীতে দৃষ্টি রাখলে দেখতে পাব, ছাত্র রাজনীতির জন্ম হয়েছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে। ১৯২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি শুরুর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। শুধু আঙ্গিক নয়, সব দিক থেকেই এই ভিন্নতা দৃষ্টান্তযোগ্য। মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, আইন করে ছাত্র রাজনীতির জন্ম হয়নি। তাই কোনো আইন করে কিংবা প্রজ্ঞাপন জারি করে তা বন্ধ করাও মোটেই উচিত হবে না। অতীতে কোনো কোনো ক্যাম্পাসে সাময়িকভাবে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এর সুফল আমরা কি পেলাম? এভাবে দুর্বৃত্তায়ন রোধ করা যাবে না, যায় না। দৃষ্টি দিতে হবে মূল ক্ষেত্রে। শুদ্ধাচারের অভিযান শুধু ছাত্র রাজনীতিতে নয়, জাতীয় পর্যায়ে দরকার। জাতীয় পর্যায়ে শুদ্ধাচারের বিষয়টি নিশ্চিত হলে ছাত্র রাজনীতি কেন, সব ক্ষেত্রেই শুভছায়া ব্যাপৃত হবে। এই যে র‌্যাগিংসহ নানা ধরনের ঘটনা ও সহিংসতার নিয়মিত চর্চা শিক্ষাঙ্গনে, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসছে, তা একদিনে হয়নি। এর শিকড়ও অনেক গভীরে প্রোথিত। এই শিকড়টা উপড়ে ফেলতে না পারলে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বিদ্যমান হতাশা দূর করা যাবে না। তাই ছাত্র রাজনীতি বন্ধ না করে তা করতে হবে কলুষমুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় ও হলসহ প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত নির্বাচন করতে হবে। জবাবদিহি-দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। আবরার তো শুধু ছাত্র রাজনীতির অপচর্চা কিংবা হীন স্বার্থবাদিতার কারণেই নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়নি। কোনো কিছু পরোয়া না করা কিংবা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা চালানোর যে অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজে জেঁকে বসেছে, আবরার হত্যা এরই বহিঃপ্রকাশ। এসব বিষয়ে দৃষ্টি না দিয়ে, উপসর্গ চিহ্নিত না করে, প্রতিকার নিশ্চিত না করে হঠাৎ করে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিলেই কি কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে?
দরকার আত্মসমালোচনা, আত্মজিজ্ঞাসা। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি এই জরুরি কাজটি সত্যিকার অর্থেই করতে পারছেন? নিকট অতীতে ছাত্রলীগের দু'জন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পাওয়া গেল এবং এ কারণে তাদের দল থেকে বাদ দিয়ে প্রতিকারের যে ব্যবস্থা নেওয়া হলো, বিষয়টি যেন সেখানেই ফুরিয়ে না যায়। এদের পেছনেও রয়েছে অনেক হাত, অনেক শক্তি। সেদিকটায় দৃষ্টি দিতে যেন ভুল না হয়। বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে শুধু এটুকুই বলব, ছাত্র রাজনীতির আমূল সংস্কার খুব জরুরি। ছাত্র রাজনীতি যদি সুস্থ ধারায় ফেরাতে হয়, এর কোনোই বিকল্প নেই। মূল বিষয়ে দৃষ্টি না দিয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিলে আখেরে এর ফল ভালো হবে না। আজ যারা জনপ্রতিনিধিত্ব করছেন, তাদের ক'জন রাজনীতির অঙ্গন থেকে অনুশীলনের মাধ্যমে পরিশীলিত হয়ে রাজনীতি চর্চায় নিবিষ্ট হয়েছেন? এই প্রশ্নটি কোনোভাবেই উপেক্ষিত থাকতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজনীতিকরণ সমাধান নয়, সমাধান হলো কলুষমুক্ত করা। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব কে করবে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিলে? মাথাব্যথার কারণ চিহ্নিত করে উপযুক্ত ওষুধ দিতে হবে। মাথা কেটে ফেলা সমাধান নয়। বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়া হলো এবং এখন অন্য ক্যাম্পাসেও এই পথ অনুসৃত হওয়া উচিত বলে কেউ কেউ যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, এর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে বলব, উৎসে দৃষ্টি দিন।

আমি জোর দিয়েই বারবার বলব, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ সমস্যার সমাধান নয়। বরং বলব, সত্যিকারের ছাত্র রাজনীতি না থাকায়ই আজকের এই অবস্থা। পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হলে এর নিরসন ঘটাতে হবে। ছাত্র রাজনীতি উন্মুক্ত হোক, প্রসারিত হোক, স্বাধীন হোক। বন্ধ হোক লেজুড়বৃত্তি। এই লেজুড়বৃত্তিই সব সর্বনাশের কারণ। ছাত্র রাজনীতি টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি বহুবিধ দুস্কর্মের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কারণও এই লেজুড়বৃত্তিই। প্রকৃত ছাত্র রাজনীতি থাকলে আজ আবরারকে এভাবে পৈশাচিকতার শিকার হতে হতো না। জ্ঞান অর্জন করতে এসে, শিক্ষা লাভ করতে এসে উচ্চ বিদ্যাপীঠে এ পর্যন্ত কতজন জীবন দিল অশুভ শক্তির থাবায়, এর পর্যালোচনা আজ খুব জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। ছাত্রদের মধ্যে আদর্শভিত্তিক চর্চার পথটা সুগম করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বের দায় রয়েছে। এই দায়টা যেন তারা ভুলে না যান। ব্যবস্থা ভালো করতে পারলে অবস্থা এমনিতেই ভালো হবে। গলদ রয়েছে ব্যবস্থায়। এই গলদের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে, যথাযথ প্রতিকার নিশ্চিত না করে হঠকারী কোনো সিদ্ধান্তে সুফল মিলবে না।

ছাত্র রাজনীতি সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে মূল সংগঠনগুলোকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। দলকানা মনোভাব নিয়ে চললে কোনো সুফল মিলবে না। অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই চিহ্নিত করতে হবে। ত্যাগ করতে হবে স্ববিরোধিতা। প্রতিহিংসাপরায়ণতা বন্ধ করে পরমতসহিষুষ্ণ হতে হবে। কেন ছাত্র রাজনীতি বেপথে গেল, আদর্শিক চর্চা অনুশীলনের বদলে অপরাজনীতি সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠল, এর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে নীতিনির্ধারকদের। সময় অনেক বয়ে গেছে। আমরা যেন আর গা ভাসিয়ে না থাকি। আদর্শিক ছাত্র রাজনীতি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কতটা অপরিহার্য, আবরারের মর্মন্তুদ জীবনহানির মধ্য দিয়ে ফের সামনে এসেছে।

ড. এমাজউদ্দীন আহমদ : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী; সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044999122619629