মাদকের ভয়াবহতা ঠেকাতে নতুন করে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন করা হয় গত বছর। ওই বছরের ২৭ ডিসেম্বর থেকে আইনটি কার্যকর হয়। এর পর থেকে নতুন মামলা নতুন আইনে বিচার হওয়ার কথা। কিন্তু আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন না করায় বা অতিরিক্ত জেলা জজ বা দায়রা জজকে তাঁর নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব না দেওয়ায় মাদক মামলার বিচারে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। সারাদেশে হাজার হাজার মামলার বিচারকাজ স্থগিত হয়ে আছে। শনিবার (১২ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আশরাফ-উল-আলম।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নতুন আইনে বিচার বিভাগীয় হাকিমদের মাদক মামলার বিচারের কোনো ক্ষমতাই দেওয়া হয়নি। তাঁদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন রদ করে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ করা হয়। এই আইনের ৪৪ ধারায় এসংক্রান্ত অপরাধ বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল স্থাপন না হওয়া পর্যন্ত সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে যে কোনো অতিরিক্ত জেলা জজ বা দায়রা জজকে তাঁর নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব দিতে পারবে। ১০ মাস আগে নতুন আইনের কার্যকারিতা শুরু হলেও এখনো ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়নি। এমনকি সরকার কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করেও কোনো অতিরিক্ত জেলা জজ বা দায়রা জজকে দায়িত্ব দেয়নি।
চলতি বছর ইয়াবা ও হেরোইন রাখার অপরাধে মাসুদুল হক নামে একজনের বিরুদ্ধে রাজধানীর বংশাল থানায় ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। অভিযোগপত্র দেয়ার পর মামলাটি ঢাকার তৃতীয় যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য স্থানান্তরিত হয়। সেখানে জামিন না পেয়ে হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন মাসুদের আইনজীবী। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে গত ৯ জুলাই আবেদনের শুনানি হয়। আইন অনুযায়ী দীর্ঘদিনেও ট্রাইব্যুনাল গঠিত না হওয়ায় আদালত স্বরাষ্ট্রসচিব ও আইনসচিবের কাছে লিখিত ব্যাখ্যা চান। হাইকোর্ট ওই দিনই বলেন, নতুন মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে যে বিচার হচ্ছে, তা বেআইনিভাবে হচ্ছে। হাইকোর্টের এ মন্তব্যের পর মূলত বিচারের জন্য প্রস্তুত মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।
এরপর গত ২৫ আগস্ট আবারও এসংক্রান্ত শুনানি হয়। ওই দিনও ট্রাইব্যুনাল না হওয়া অথবা ট্রাইব্যুনাল গঠিত না হওয়া পর্যন্ত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজকে মাদক মামলা বিচারের দায়িত্ব না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন উচ্চ আদালত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে করা নতুন আইনটি কার্যকর হওয়ার পর যত মামলা হয়েছে, সেগুলোর অভিযোগপত্র দাখিল করার পর আগের মতোই বিভিন্ন দায়রা আদালতে বিচারের জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্টের একটি আদেশের পর ওই সব মামলাও সংশ্লিষ্ট আদালতগুলো দায়রা জজ আদালতে ফেরত পাঠিয়েছেন।
আইনের ৫১ ধারায় বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালে মামলা বিচারের জন্য স্থানান্তরিত হওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করতে হবে। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল গঠিত না হওয়ার কারণে বিচারকাজ স্থগিত থাকায় হাজার হাজার মামলা ঝুলে আছে। এসব মামলা ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়ার সুযোগ নেই। আবার অনেক মামলার আসামিরা কারাগারে আছে। তাদের জামিনের আবেদনেরও শুনানি হচ্ছে না।
জানা গেছে, ঢাকা অঞ্চলে ১৮ হাজার, চট্টগ্রাম অঞ্চলে আট হাজারের বেশি মামলার কার্যক্রম বর্তমানে স্থগিত হয়ে আছে। এ ছাড়াও সারা দেশের আদালতে আরো কয়েক হাজার মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে আছে। ট্রাইব্যুনাল গঠন বিষয়ে হাইকোর্টে আগামী ১৩ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য আছে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর লাবনী সেন্টারের সামনে থেকে গ্রেফতার হন কেরানীগঞ্জের ওয়াশপুরের বাসিন্দা মো. ইয়াকুব। তাঁর কাছ থেকে পাঁচ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ থানায় ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১)-এর ৮(ক) ধারায় মামলা হয়। অভিযোগপত্র দেয়ার পর মামলাটি ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বদলি হয়। কিন্তু হাইকোর্টের আদেশের পর জামিন শুনানি করতে পারছেন না তাঁর আইনজীবী। আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন বা সাক্ষ্যগ্রহণ কোনো কিছুই হচ্ছে না।
ইয়াকুবের আইনজীবী এল সি দাস বলেন, ‘সব কার্যক্রম বন্ধ। জামিন শুনানিও বন্ধ। আসামি তাঁর সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’
গত মার্চে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় মো. কালু নামের একজন ২০০ পিস ইয়াবাসহ আটক হন। তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলায় অভিযোগপত্র দেয়ার পর সেটা ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। এ মামলার কার্যক্রমও বন্ধ। তাঁর আইনজীবী সিকদার ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘আসামির পক্ষে জামিন আবেদন করার পর তা বিচারক শুনছেন না।’
আইন সংশোধনের উদ্যোগ : শুধু ট্রাইব্যুনাল গঠন নয়, আগের আইনে মাদকের পরিমাণ কম হলে বিচার বিভাগীয় হাকিম বা মহানগর হাকিমরা ওই মামলার বিচার করতেন। নতুন আইনে তাঁদের বিচারের ক্ষমতা দেয়া হয়নি। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালতকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ সংসদে পাস হওয়ার পর গত ৩ মার্চ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা থেকে ধারাটি সংশোধনের প্রস্তাব সুরক্ষা সেবা বিভাগ ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছিল। আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, এ ধারাটির কারণে আইনের প্রয়োগে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটি সংশোধন করা দরকার। যুক্তি হিসেবে মন্ত্রণালয় জানায়, সারাদেশে বিচারাধীন মামলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিচার বিভাগীয় হাকিম আদালতে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বেশি।
জানা গেছে, আইন মন্ত্রণালয় প্রস্তাব পাঠালেও কর্ণপাত করেনি সরকারের দুই বিভাগ। হাইকোর্টের মন্তব্যের পর তাদের টনক নড়ে। শেষ পর্যন্ত আইন সংশোধনের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে বলে আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিচারিক ক্ষমতা কারা পালন করবেন, তা সংশোধনীতে এসেছে। শিগগিরই সংসদে সেটা পাস হবে। এরপর আর সমস্যা থাকবে না।