মানুষ হওয়ার জন্য কি সাংস্কৃতিক আয়োজন আছে?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

গান্ধীজি বলেছিলেন, আমার মনে হয় ইংরেজরা চলে গেলেও পঞ্চাশ বছরের মধ্যে আমরা আবারও পরাজিত হয়ে যাব। সেই পরাধীনতা হয়তো যুদ্ধে পরাজয়ের রূপ নিয়ে আসবে না। আসবে অন্যভাবে। এত লোকের প্রাণদান, এত আত্মত্যাগ, এত বিসর্জন এবং ভারতের মহান দর্শন সবই বৃথা যাবে। শনিবার  (১৩ জুলাই)  যুগান্তরে প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন জয়া ফারহানা।

কোনো জাতির পক্ষেই বড় হওয়া সম্ভব নয় যদি তাদের সততা, কঠোর পরিশ্রম ও নিয়মানুবর্তিতা না থাকে। দু’শ বছর ইংরেজদের বুটের নিচে চাপা পড়ে আমরা কুঁইকুঁই করেছি বটে; কিন্তু যখনই নিজেরা ক্ষমতা হাতে পাব তখন হয় সাহেব হব, নয়তো চোর।

গান্ধীজির বাণী মিথ্যা হয়নি। আর সব ক্ষেত্রের কথা যদি বাদ দিই কেবল রেলের কথাই বলি, গান্ধীজির ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যায়। ব্রিটিশ আমলে রেলভ্রমণের অনেক সুখকর অভিজ্ঞতার কথা বর্ষীয়ানদের মুখে শুনেছি। তখনকার প্রতিটি ট্রেনই ছিল একেকটি অরিয়েন্ট এক্সপ্রেস।

গ্রাহাম গ্রিন ও আগাথা ক্রিস্টি এ অরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের খাওয়া-দাওয়ার কী চমৎকার বর্ণনাই না দিয়েছেন! সুইজারল্যান্ডের গ্রুয়ে শহরের পনির, টাটকা তাজা রুটি, ব্রাজিলের কালো কফি। অরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের বুফের সঙ্গে ব্রিটিশ আমলের বুফের খাবারের মানে খুব কিছু তফাত ছিল না।

শুধু খাবারের মান নয়, পরিচ্ছন্ন টয়লেট, ঝকঝকে-তকতকে বসার আসন, সব মিলিয়ে রেলযাত্রা আনন্দদায়ক ছিল বলেই বাংলা সাহিত্য পেয়েছে ‘হঠাৎ দেখা’র মতো কবিতা। অপু-দুর্গার বিস্ময়ের সেই ট্রেন আজ কী বেহাল দশাতেই না পতিত হয়েছে! না, অতীত নিয়ে আমাদের কোনো সুচিবায়ুগ্রস্ততা নেই।

কিন্তু রেলের নিয়মিত যাত্রী মাত্রই বলতে পারবেন খাবার, টয়লেট, আসনসহ রেলের সব ধরনের সেবার মানের কতদূর অবনতি হয়েছে। নষ্ট স্লিপার, আলগা নাটবল্টু, জরাজীর্ণ রেলসেতুর ওপর দিয়ে কতটা ঝুঁকি নিয়ে রেল যাচ্ছে তা বেশকিছু দিন ধরে পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে নিয়মিত।

অধিকাংশ স্লিপারের সঙ্গে লাইন লাগানো নেই, ক্লিপ খোলা, ফিশপ্লেট খোলা, হুকও খোলা। পাথর না থাকায় অনেক জায়গায় পানি জমে গেছে। কিন্তু কেউ এর দায় নিচ্ছেন না। প্রতিবেদকরা একবার ছুটছেন স্টেশন মাস্টারের কাছে।

তিনি বলছেন, এসব দেখার দায়িত্ব যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের। আর পুরকৌশল বিভাগের কীম্যানরা বলছেন, স্লিপার বদলানোর জন্য নোট দেয়া হয়েছে; কিন্তু কেউ গা করেনি। প্রশ্ন হল, ফিশপ্লেট, হুক, ক্লিপ, পাথর এত ঘনঘন চুরি হওয়ার কারণ কী? এসব যেন চুরি না যায় তার জন্য তো রেল বিভাগের ওয়েম্যান থাকার কথা।

সাংবাদিকদের কাছে রেল কর্মকর্তারা বলেছেন, গত কয়েক বছরে যেসব ওয়েম্যান নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারা কেউ মাঠে কাজ করতে চায় না। আবার তাদের নাকি কিছু বলাও যায় না। কারণ তারা ওয়েম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন রাজনৈতিক প্রভাবে। ওয়েম্যানরা কাজ করেন না বলেই রেলের পাথর, নাটবল্টু, ক্লিপ, হুক চুরি যাচ্ছে। রাষ্ট্রের সম্পদ তদারকির দায়িত্ব ছিল যাদের তারা বেতন নিচ্ছেন ঠিকই; কিন্তু চুরি ঠেকাচ্ছেন না। নাটবল্টু চুরির নাটের গোড়া তবে তারাই?

রেল দুর্ঘটনার বড় কারণ লাইনচ্যুতি। পাথর, নাটবল্টু, ক্লিপ, হুকবিহীন লাইনে ট্রেন চললে তা ছোট-বড় দুর্ঘটনার মুখে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। কোনো দুর্ঘটনাকে ছোট বলাটা সঙ্গতও নয়। লাইনচ্যুতির কারণে কেউ নিহত-আহত না হন, পৌঁছাতে দেরি হওয়াটাও তো কম ক্ষতি নয়।

সময়ের অপচয়কে আমরা হিসাবের মধ্যে গুনি না বলেই বলতে হয় ন’টার ট্রেন ক’টায় আসবে। ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিছু পাতি ক্ষমতাবানের অনৈতিক খবরদারির কারণে উন্নয়নের অর্থ ‘অনুন্নয়নের উন্নয়ন’ হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। দেশের সম্পদ চুরির ব্যবস্থা যারা করে দিচ্ছেন তাদের ছেলেমেয়েরা কেউ এদেশে থাকবেন না।

৯০ শতাংশ রাজনীতিকের ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে পড়াশোনা করে। সম্ভবত সে কারণেই রেল গেল কী নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে নৌপথ চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে গেল তাতে তাদের কিছুই আসে-যায় না। প্রাচ্যের অরিয়েন্ট এক্সপ্রেস তাই পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে।

২.

ইন্টারনেটের সৌজন্যে পড়াশোনা, বিনোদন, টাকা-পয়সার লেনদেন, ব্যাংকিং থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক জীবনচর্চায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। শপিংমল থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ, রেলস্টেশন এমনকি ভিড়ের বাসেও ফ্রি ওয়াইফাই জোন না থাকলে তা নতুন প্রজন্মের গ্রাহক টানতে পারছে না।

যানজট এড়াতে অনেক কর্পোরেট অফিস ভিডিও কলিং, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সেরে নিচ্ছে। নেট ব্যাংকিংয়ের সৌজন্যে ঘরে বসে টাকা-পয়সা লেনদেন, ফিক্সড ডিপোজিট খোলা কিংবা পাস বুক আপডেট করা যাচ্ছে।

জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট-ভিসা তৈরির প্রাথমিক কাজ শুরু করা যাচ্ছে অনলাইনে। গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল তো দেয়া যাচ্ছেই। বেশিরভাগ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থাকায় আগে যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো এখন সেখানে কাজ হচ্ছে একটি ক্লিকেই।

যানবাহনের টিকিট থেকে শুরু করে মাসের বাজার করার সুযোগও পাওয়া যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এসেছে ই-লার্নিং। মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে রাইড শেয়ারিং কিছুটা হলেও যানবাহনের সংকট কমিয়েছে। শহরের উল্লেখযোগ্য সড়কগুলোতে এলইডি বাতি জ্বলছে।

মোবাইলে অর্ডার দিলে ঘণ্টার মধ্যে মিলে যে কোনো ব্র্যান্ডের খাবার। বিশ্বের সব নামিদামি চেইন শপের আউটলেট রয়েছে ঢাকায়। এক বছর আগেও ভাবা যেত না ঢাকায় বসেই মিলে যেতে পারে বুমে মার্সার, রেমন্ড উইল, মন্টব্লা বা পিয়েরে লাইনারের মতো নামিদামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি।

আমরা বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠছি তবে! কিন্তু ব্র্যান্ডেড পোশাক অ্যাক্সেসরিজ অথবা সিটিজেন থেকে নেটিজেনে রূপান্তরিত হওয়া কতখানি মানুষ করতে পারল আমাদের? যাবতীয় বিশ্বমানের পরিষেবা আমাদের মানুষ থেকে পশুতে রূপান্তরিত করেছে বললে ভুল হবে?

প্রমাণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রতিদিনের পত্রিকার খবরে। শিশু ও নারী ধর্ষণের ট্রমাটাইজড খবরগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। কিন্তু সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, তথ্যপ্রযুক্তির এত সুবিধা পেয়েও আমরা কেন সংস্কৃতিবান হয়ে উঠতে পারলাম না?

৩.

ঠিক যে, কয়েক দশক আগের ঢাকায় এত টেকনোলজিক্যাল সুবিধা ছিল না। কিন্তু তখনকার সংস্কৃতিজনদের লেখা থেকে জেনেছি ঢাকা বরং তখনই অধিকতর উচ্চ সংস্কৃতির শহর ছিল। ষাটের দশকে গুলিস্তান এবং নাজ সিনেমা হলে এসেছে ‘লাভ ইন দি আফটার নুন’, ব্রেকফার্স্ট অ্যাট টিফানি’, ‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই’, ‘দ্য ম্যান উইথ দ্য গ্রে ফ্লানেলে’র মতো সিনেমা।

কত ভালো সঙ্গীত, নাটক ও চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে এ ঢাকায়। এখন এক কিবোর্ডেই সব সুরের আয়োজন করা হচ্ছে। বোদ্ধা সঙ্গীতজ্ঞরা তো জানেনই, এমনকি আমাদের মতো তুচ্ছ শ্রোতারাও জানেন ‘মীড়ের মোচড়’ কখনও কিবোর্ড দিতে পারে না। গ্রামোফোন কিংবা সিলভার ডিস্কের সুরেলা ঝংকার কখনও এমপি থ্রিতে পাওয়া সম্ভব নয়।

মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ঘটোৎকচের জন্ম হয়েছিল পাণ্ডবদের দ্বিতীয় ভাই ভীমের ঔরস এবং হিড়িম্বার গর্ভে। মহাভারতের পাঠকমাত্রই জানেন ঘটোৎকচ জন্মানোর ক্ষণ থেকেই যুবক, তার কোনো শৈশব নেই। ইউটিউব জেনারেশনেরও হয়েছে ঘটোৎকচের দশা। জন্ম মাত্রই গাদাগুচ্ছের গ্যাজেটের মধ্যে এরা প্রত্যেকেই তরুণ-তরুণী, শৈশব অতিক্রম না করেই।

৪.

যেদিন আমাদের মন বলবে, সবাই ভালো থাকুক, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়-অনাত্মীয়, ত্যাগী-ভোগী, গুণী-নির্গুণ সবাইকে ক্ষমা করে দিতে পেরেছি, কারও কাছে কিছুমাত্র পাওনা নেই, সেদিন আমরা সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারব। তার জন্য কোনো সাংস্কৃতিক আয়োজন আছে?

লেখক: জয়া ফারহানা, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032649040222168