মারধরে অসুস্থ হলে আবরারকে অন্য রুমে নিয়ে গিয়ে পেটাই : রবিন

নিজস্ব প্রতিবেদক |

বুয়েটের  ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আরও এক আসামি বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। সোমবার (১৪ অক্টোবর) ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তিনি বলেন, ‘আবরারকে আমিও চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি মেরেছি।’ আবরারকে একটি কক্ষে মারধর করার পর অসুস্থ হয়ে পড়লে আরেকটি কক্ষে নিয়ে ফের পেটানো হয়।

পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা লালবাগ জোনাল টিম, গোয়েন্দা (দক্ষিণ) বিভাগের পুলিশ পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান আবেদন করেন রবিনের জবানবন্দি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করার। ঢাকা মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন তাঁর জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। গত ৮ অক্টোবর অন্য আসামিদের সঙ্গে রবিনকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়।

এদিকে শিবির সন্দেহে পেটানোর কারণে আবরারের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম। গতকাল সকালে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে চারজনের আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে এসেছে যে তারা শিবির সন্দেহে আবরারকে ডেকে নিয়ে পিটিয়েছে। একপর্যায়ে তার মৃত্যু হয়।’

এ সময় অপর এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বাকিদের জবানবন্দির পাশাপাশি তথ্য-প্রযুক্তির বিশ্লেষণ ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে যে তারা আবরারকে হত্যার উদ্দেশ্যে পিটিয়েছিল নাকি অন্য কোনো কারণে। 

ওই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে ব্যাখ্যা দিয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ রাত ২টায় নয়, ৩টার পরে গিয়েছিল বুয়েট ক্যাম্পাসে, কিন্তু পুলিশকে বলা হয়েছিল ভেতরে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা থাকলে, কেউ (কর্তৃপক্ষ) জানালে তখন পুলিশ ঢোকে। সমস্যা না থাকলে হলের ভেতরে যাওয়ার রেওয়াজ নেই।’

আগামী মাসে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, আগামী মাসের শুরুতে বিজ্ঞ আদালত যে তারিখ দিয়েছেন তার আগেই অর্থাৎ আগামী মাসের শুরুর দিকেই মামলার তদন্তকাজ শেষ হবে। তখন আমরা একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র দিতে পারব।’

রবিনের স্বীকারোক্তিতে যা আছে : আদালত সূত্রে জানা গেছে, রবিন আদালতকে বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েকটি স্ট্যাটাসে আবরারের প্রতি সবার নজর পড়ে। আবরার শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ হয়। আবরার হত্যাকাণ্ডের চার-পাঁচ দিন আগে থেকে তাকে খোঁজা হচ্ছিল। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে আবরারকে শায়েস্তা করার আহ্বান জানালে অনেকে এতে সায় দেয়। কিন্তু আবরার হলে না থাকায় ফেরার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সিদ্ধান্ত হয়।’

গত ৬ অক্টোবর বিকেলে আবরার হলে ফিরলে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন তাঁকে ডেকে শায়েস্তা করা হবে। ওই দিন রাত ৮টার দিকে মেহেদী হাসান রাসেল আবরারকে সন্ধ্যার পর ডেকে আনতে নির্দেশ দেন। জেমি, মোয়াজসহ কয়েকজন তাঁকে ডেকে আনেন। রাত ৮টার পর ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরারকে আনার পর একে একে তোহা, মনির, রাফাত, বিল্লাহ, মাজেদ, মোয়াজ, অনিক, জেমি, তানভীর, তানিমরা আসেন। রবিনও যান। আবরারকে অনেক প্রশ্ন করা হয়। হলে কে কে শিবির করে তা জিজ্ঞাসা করা হয়। আবরার নিশ্চুপ থাকেন। এরপর রবিনই তাঁকে চড়-থাপ্পড়, স্টাম্প দিয়ে পেটানো শুরু করেন। তারপর আরো কয়েকজন চড়-থাপ্পড় কিল-ঘুষি মারা শুরু করেন। একপর্যায়ে একজন পাশের কোনো কক্ষ থেকে ক্রিকেট স্টাম্প নিয়ে আসেন। ওই স্টাম্প দিয়ে ইফতি মোশাররফ সকাল ও অনিক সরকার আবরারকে পেটাতে থাকেন। একসময় ক্রিকেট স্টাম্প ভেঙে যায়। পরে ওই ভাঙা স্টাম্প দিয়েই আবরারকে সবাই মিলে পেটান। পরে লাঠিসোঁটা এনে কেউ কেউ পেটান। মুজাহিদ ও কয়েকজন স্কিপিং দড়ি দিয়েও পেটান।

মেহেদী হাসান রবিন স্বীকারোক্তিতে আরো বলেন, ‘সকাল, জিসান, তানিম, সাদাত, মোরশেদ বিভিন্ন সময় ওই কক্ষে আসে এবং আবরারকে পেটায়। মোয়াজ, বিটু, তোহা, বিল্লাহ ও মুজাহিদও ঘুরে ফিরে এসে আবরারকে পেটায়। একপর্যায়ে আবরার নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কয়েকবার বমিও করে। এতেও পেটানো বন্ধ করা হয়নি। একপর্যায়ে আবরারকে ধরাধরি করেন তানিম, মেয়াজ, জেমি সিঁড়ির দিকে নিয়ে যায়। পেছনে মোরশেদ, মুজাহিদ, তোহা, বিল্লাহ, মাজেদও ছিল। পরে ডাক্তার ডাকা হয়। ডাক্তার এসে বলেন আবরার মারা গেছে।’

বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে গত ৬ অক্টোবর রাতে শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়।  আবরার হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ১৯ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাঁদের মধ্যে আটজনকে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি।

রবিনসহ আবরার হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে এ পর্যন্ত পাঁচজন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা হলেন—বুয়েটের ছাত্র ইফতি মোশাররফ সকাল, মেফতাহুল ইসলাম জিওন, অনিক সরকার, মো. মোজাহিদুর রহমান ও মেহেদি হাসান রবিন। এ ছাড়া এজাহারভুক্ত ১৯ জনের মধ্যে চারজন এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। এরা হলেন—মো. জিসান, মো. শাদাত, মো. মোর্শেদ  ও  মো. তানিম। এরা সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আবরার হত্যাকাণ্ডে জড়িত রয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে তথ্য পাওয়া গেছে।

আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আসামি বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন স্বীকারোক্তিতে আরো বলেছেন, আবরারকে পিটিয়ে হত্যার আগে তাঁদের প্রথম পরিকল্পনা হয় বুয়েট ক্যান্টিনে। এরপর ম্যাজেঞ্জারের মাধ্যমেও তাঁরা একে অন্যের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035150051116943