মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের হাজার কোটি টাকা জলে!

শরীফুল আলম সুমন |

দেশের ৩৫ হাজারেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এরই মধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের যাবতীয় সরঞ্জাম। আর যেসব স্কুলে এই ক্লাসরুম করা হয়েছে সেখানকার একজন করে শিক্ষককে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। এই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের পেছনে সরকার এরই মধ্যে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনে আরো প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান, কিন্তু এত টাকা খরচ করেও এর সুফল  পাওয়া যাচ্ছে না।

একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খবর নিয়ে জানা যায়, এখনো অনেক প্রতিষ্ঠানেই প্যাকেটবন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে মাল্টিমিডিয়া সরঞ্জাম। বিদ্যুৎ ও প্রয়োজনীয় শ্রেণিকক্ষ না থাকায়ও অনেক প্রতিষ্ঠান মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের ব্যবহার করতে পারছে না। এ ছাড়া এই ক্লাসরুম ব্যবহারে শিক্ষকদের অনেকের মধ্যেও প্রচণ্ড অনীহা রয়েছে। আবার অনেকে যাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তাঁরা নিয়মিত ব্যবহার না করায় সব কিছুই ভুলে গেছেন। সরঞ্জাম নষ্ট হওয়ার পর তা মেরামতের জন্য কোনো ফান্ড না থাকায়ও সেগুলো পড়ে থাকে। সর্বোপরি মাঠপর্যায়ের দুর্বল তদারকির কারণে শিক্ষা প্রশাসনে এর প্রকৃত চিত্রও উঠে আসছে না। আর এতে ব্যাহত হচ্ছে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কার্যক্রম।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এত দিন মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানে যেসব ল্যাপটপ দেওয়া হয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই টেসিসের, যার অর্ধেকই নষ্ট অবস্থায় রয়েছে। প্রতিটি বিদ্যালয়ের নিজস্ব একটি ফান্ড থাকলেও নষ্ট মাল্টিমিডিয়া সরঞ্জাম তারা নিজের টাকায় মেরামতে আগ্রহী নয়। এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধানই নিজে তা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন। আবার অনেক সময় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না থাকায়ও শিক্ষকরা ক্লাস নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। কারণ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের জন্য কনটেন্ট ডাউনলোড করে আলাদা প্রস্তুতি নিতে হয়। শিক্ষকরা কোনোভাবেই কষ্ট করতে রাজি নন।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আইসিটির বর্তমান প্রকল্পটি মূলত দ্বিতীয় ফেজ। প্রথম পর্যায়ে যদি কোনো সমস্যা থাকে তা এই প্রকল্পের মাধ্যমে সমাধান করা হবে। এ ছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম দেওয়া বাকি আছে, যেসব প্রতিষ্ঠানে একাধিক দরকার এবং যাদের বিদ্যুৎ নেই তাদেরও এই প্রকল্পের মাধ্যমে ক্লাসরুম দেওয়া হবে। এই প্রকল্পে শিক্ষকদের বড় ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদেরও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম তদারকি করতে বলা হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এই ক্লাসরুম ব্যবহার করছে। তবে সবাইকে আনতে আরো কিছু সময়ের প্রয়োজন।’

জানা যায়, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে প্রতিদিন ছয়টি করে পিরিয়ড নেওয়া হয়। সেই হিসাবে প্রতিটি ক্লাসের প্রতিদিন একটি করে ক্লাস মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে হওয়ার কথা এবং তা ড্যাশবোর্ডে (মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমসংক্রান্ত ওয়েবসাইট) ওঠানোর কথা। কিন্তু মাউশি অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত মাত্র কয়েকটি জেলা সন্তোষজনক মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহার করেছে। বাকিদের ব্যবহারের হার খুবই কম। আবার অনেক স্কুলই নিয়মিত মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে ক্লাস করানোর কথা ড্যাশবোর্ডে তুললেও বাস্তবে ক্লাস নিচ্ছে না। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও প্রতিটি ক্লাসের প্রতিদিন একটি করে ক্লাস মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে নেওয়ার কথা। কিন্তু এক মাসেও একটি ক্লাস করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ময়মনসিংহ শহরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান রাধা সুন্দরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এই স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম থাকার পরও দুই বছর ধরে ক্লাস হয় না। প্রজেক্টরটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মেরামতের জন্য তহবিল না থাকায় তা আর সচল করা যায়নি। টাঙ্গাইলের সখীপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া সরঞ্জাম থাকার পরও ক্লাস নেওয়া হয় না। কারণ হিসেবে ক্লাসরুমের অভাবের কথা জানান ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক। টাঙ্গাইলের হাতিবান্ধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাসরুম থাকার পরও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে এর ব্যবহার হচ্ছে না।

কুমিল্লার মুরাদনগরে ইউছুফনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ না থাকায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কিশোরগঞ্জ সদরের নান্দলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একই অবস্থা। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ভগীরথপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়ার সরঞ্জাম প্যাকেটবন্দি। ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তা প্যাকেটে ভরে রেখে দিয়েছেন শিক্ষকরা। নীলফামারীর তালুকবদি উচ্চ বিদ্যালয়েও নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে ল্যাপটপ। এ ছাড়া তাদের কম্পিউটার শিক্ষকও নেই।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর সূত্র জানায়, আইসিটি প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে প্রায় ২৩ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদরাসা ও কলেজে এরই মধ্যে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে প্রকল্পটি শেষ হয়েছে। ৩০৫ কোটি ৬৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকার প্রকল্পে একটি করে ল্যাপটপ, স্পিকার, ইন্টারনেট মডেম, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্ক্রিন সরবরাহ করা হয়েছে। এরপর আইসিটি প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন হাজার ৩৪০টি স্কুলের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকা আরো প্রায় পাঁচ হাজার বেসরকারি স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে। এই প্রকল্পে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত।

তবে আইসিটির দ্বিতীয় পর্যায়ের এই প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিনের বিরুদ্ধে অনৈতিক তৎপরতা, ডিপিপি উপেক্ষা করে ক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা, পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রকল্প পরিচালককে এরই মধ্যে ওএসডি করা হয়েছে। ফলে অনেকটাই থমকে গেছে কাজ।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন উইংকে এই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম পরিদর্শনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ২০১৬ সালের শেষ দিকে তারা সর্বশেষ ৯ জেলার ১২টি উপজেলার ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে। তবে এই উইং রাজস্ব খাতভুক্ত না হওয়ায় গত এক বছর এর কোনো কার্যক্রম ছিল না। ফলে কেন্দ্রীয়ভাবে আর কোনো পরিদর্শনও হয়নি। তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনেও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের এই দুরবস্থার চিত্র উঠে আসে।

তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, অনেক প্রতিষ্ঠানেই দীর্ঘদিন ধরে ল্যাপটপটি অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। শিক্ষকদের আইসিটি সম্পর্কে ধারণাও কম। আর এই ক্লাসরুম ব্যবহার করার জন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের তৎপরতাও নেই। এমনকি জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তারাও এ ব্যাপারে খুব একটা মনিটরিং করেন না। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের রুটিন নির্দিষ্ট করা নেই। ফলে শিক্ষকদের ইচ্ছা হলে মাঝেমধ্যে এই ক্লাসরুম ব্যবহার করেন।

প্রতিবছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের ব্যবহার নিশ্চিত করতে অনুরোধ জানানো হয়। তবে এর আগে জেলা প্রশাসকরা একাধিক বিদ্যালয়ে সরেজমিন পরিদর্শন শেষে একাধিকবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। সেখানেও দেখা যায়, বেশির ভাগ শিক্ষকই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহারের সঙ্গেই পরিচিত নন। ল্যাপটপটির ব্যক্তিগত ব্যবহার হলেও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্ক্রিন পড়ে রয়েছে। এমনকি অনেক শিক্ষার্থীই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম কী তা জানে না। জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারাও পরিদর্শন করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের বিষয়ে পরামর্শ দেন না।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৪ হাজার ৮২০টি। তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৩) আওতায় এরই মধ্যে ১২ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। আর চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) আওতায় শিগগিরই আরো ৫০ হাজার বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল  বলেন, ‘আমরা চলতি বছরের মধ্যেই বাকি ৫০ হাজার বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম করতে চাই। এ ছাড়া যে বিদ্যালয়ে এই ক্লাসরুম দেওয়া হচ্ছে সেখানকার একজন শিক্ষককে ১২ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এই ক্লাসরুম যাতে ব্যবহার করা হয় সে ব্যাপারটি তদারকি করতেও আমরা শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি। আর কোনো সরঞ্জাম নষ্ট হলে ব্যাপারটি সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবহিত করলে তিনি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন।’

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0058779716491699