মেডিকেলে ভর্তি জালিয়াতি, কোটি টাকার লেনদেন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে আসছে। এই ফাঁস চক্রে প্রেসের কর্মী, তাঁদের আত্মীয়, মেডিকেলের শিক্ষার্থীসহ চিকিৎসক জড়িত। এমন অন্তত ১৫০ জনের নাম উঠে এসেছে গ্রেফতার ৯ আসামির মধ্যে ছয়জনের দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে। সর্বশেষ গত ১৪ আগস্ট আসামি সানোয়ার হোসেন ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। শনিবার (২২ আগস্ট) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন এস এম আজাদ।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পাওয়া গেছে, যাঁরা জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও কলেজগুলোকে তাঁদের ব্যাপারে তথ্য দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

আসামিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে এমবিবিএস পাস করা জেড এম এ সালেহীন শোভন প্রশ্নফাঁসের অন্যতম হোতা। জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া বরিশাল মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী মাহমুদা পারভীন ঋতু, সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজের রিয়াদ এবং ইব্রাহিম কার্ডিয়াক মেডিকেল কলেজের মুবিন এই চক্রের সহযোগী হয়ে কাজ করছেন।

এদিকে প্রশ্ন ফাঁস চক্রের প্রধান জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া ওরফে মুন্নুর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাচ্ছেন তদন্তকারীরা। তাঁর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা দায়েরের জন্য অনুসন্ধান চলছে। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জসিমের খালাতো ভাই ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রেসের কর্মী আব্দুস সালাম,  চিকিৎসক সালেহীন শোভনসহ পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করা যায়নি।

সূত্র জানায়, ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে র‌্যাবের হাতে জসিম ও শোভন গ্রেফতার হলেও জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের অপকর্মে জড়ান তাঁরা। অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা জানান, জবানবন্দিতে যাঁদের নাম এসেছে তাঁদের ব্যাপারে তদন্তের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিভাগে তথ্য যাচাই শুরু হয়েছে।

২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন ফাঁস তদন্তের সূত্রে মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসের তথ্য পায় সিআইডি। গত ১৯ ও ২০ জুলাই রাজধানীর মিরপুর থেকে চক্রের মূল হোতা জসিম, সহযোগী সানোয়ার হোসেন, মোহাইমিনুল ওরফে বাঁধন, জসিমের ছোট বোনের স্বামী জাকির হোসেন দিপু ও ভাতিজা পারভেজ খানকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত এই পাঁচজন এবং পলাতক ৯ জনের নাম উল্লেখসহ দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে ২০ জুলাই মামলা করে সিআইডি। এরই মধ্যে জসিমের বোন শাহজাদী আক্তার মিরা, ভগ্নিপতি আলমগীর হোসেন, সহযোগী মুবিন ও ইমনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে জসিম, মিরা, আলমগীর, বাঁধন ও সানোয়ারকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি। রিমান্ড শেষে গত ১৪ আগস্ট আদালতে হাজির করা হলে সানোয়ার স্বাীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এর আগে জবানবন্দি দেন আলমগীর, দিপু, পারভেজ, ইমন ও মুবিন।

সিআইডির একাধিক সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে সানোয়ার ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে এবং ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রশ্নফাঁসের কথা জানান। তাঁদের সঙ্গে সালাম ও শোভন ছাড়াও মেডিক্যালের কিছু শিক্ষার্থী জড়িত ছিলেন বলেও জানান তিনি। মেডিক্যালের চারজনই টাকার বিনিময়ে ভর্তির চুক্তি করতেন।

সিআইডির তদন্ত সূত্র জানায়, মেডিক্যালে প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে ভর্তি চক্রের অন্যতম সালেহীন শোভন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে এমবিবিএস পাস করেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিলের নারায়ণপুরে। বাবার নাম জিহাদুল ইসলাম। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনিসহ জসিম। জসিমের নেতৃত্বে পারিবারিক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজের প্রশ্নফাঁস হচ্ছে। শোভনসহ সরাসরি চক্রে জড়িত অর্ধশতাধিক ব্যক্তি।

জসিমের খালাতো ভাই স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মেশিনম্যান আবদুস সালাম প্রশ্ন ছাপানোর সময় তা ফাঁস করতেন। প্রশ্ন ছড়িয়ে দেয়ার কাজ যাঁরা করতেন তাঁদের মধ্যে জসিমের ভাতিজা পারভেজ খান, বোনজামাই জাকির হোসেন দীপু, ভায়রা ভাই সামিউল জাফর, দুলাভাই আলমগীর হোসেন, স্ত্রী শারমিন আরা জেসমিন শিল্পী ও ভাগ্নে রবিন রয়েছেন।

সূত্র জানায়, জসিমের কাছ থেকে দুই কোটি ২৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, দুই কোটি ৩০ লাখ টাকার চেক এবং পারভেজের কাছ থেকে ৮৪ লাখ টাকার চেক জব্দ করা হয়েছে। জসিমের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুল আহসান বলেন, ‘চিকিৎসক শোভনের বিষয়ে আমরা কিছু তথ্য পেয়েছি। তাঁকে এখনো আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। জসিমসহ পুরো চক্রের বিষয়ে আমাদের অনুসন্ধান অব্যাহত আছে।’

সিআইডির আরেক কর্মকর্তা জানান, বরিশাল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী মাহমুদা পারভীন ঋতু, সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজের রিয়াদ এবং ইব্রাহিম কার্ডিয়াক মেডিকেল কলেজের মুবিন ভর্তির পাশাপাশি চক্রে সহায়তা করেছেন। এমন আরও শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পাওয়া গেছে, যাঁরা জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও কলেজগুলোকে তাঁদের ব্যাপারে তথ্য দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে মেডিকেল কলেজে ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হওয়ার অভিযোগ তুলে রাস্তায় নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘেরাও এবং উচ্চ আদালতে রিট করা হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি নাকচ করে দেয়। এরপর ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন ফাঁস জালিয়াতির তদন্ত চলাকালে মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসের তথ্যও উঠে আসে। জালিয়াতি ধরা পড়ায় প্রথম দফায় ১৫ জন এবং গত ২৮ জানুয়ারি ৬৩ জনকে বহিষ্কার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত বছরের ৩০ মে সিআইডি ১২৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়, যাঁদের ৮৭ জনই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

মেডিকেলের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত, জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন বলেন, ‘প্রমাণ পেলে যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পরীক্ষা দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ডিএমডির সঙ্গে সমন্বয় করে বিধিগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.011127948760986