এ দুঃখ রাখব কোথায়। আর কতবার বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ছাত্র খুন হবে? তাদের খুনীরা কেন তাদেরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেধাবী ছাত্র? বুয়েটে মেধাবী ছাত্র ফাহাদকে হত্যা করেছে যারা তারাও মেধাবী ছাত্র। এ দেখে সেই দীপের কথা মনে পড়ে গেল। দীপ চাপাতির আঘাতে শিবির কর্মী দ্বারা তার কক্ষেই প্রায় মরমর অবস্থায় পড়েছিল। পরে তার বন্ধুরা তাকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়, যেখানে সে কোমায় ছিল প্রায় তিন মাস। বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
একদিন আমি স্কয়ার হাসপাতালে একটি কাজে গেলে দীপের খবর নার্সদের কাছ থেকে জানতে চাই। সে বেঁচে উঠবে তো, সেটি ছিল আমার চিন্তার বিষয়। নার্সরা জানিয়েছিল, সম্ভবত নাও বাঁচতে পারে। এরপর আমার বড় ভাবিকে স্কয়ারে ভর্তি করাতে যেদিন নিয়ে যাই সেইদিন দীপের মৃত্যু হয় জেনে আমি একটি বিশাল আঘাত পেয়েছিলাম। এরপর শিবিরের হাতে আরও খুন হয় রাজীব, অভিজিৎ, নিলয়, দীপনসহ একঝাঁক প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ!
আমাদের মতো পরিবারের মানুষকে এ ধরনের নির্মম বর্বর ঘটনা হতভম্ব করে দেয় এ কথা ভেবে যে, আমরা, আমাদের ভাই, ভাইপোরা অপর কোন সহপাঠী বা পরিচিত, অপরিচিতজনের গায়ে হাত তুলবে এটি অবিশ্বাস্য। তার ওপর পরিকল্পনা করে ডেকে এনে ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে মুখ বেঁধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেটাতে পারে কোন তরুণ বা একদল তরুণ, যারা মেধাবী এবং উচ্চ শিক্ষার শিক্ষার্থী। এর চেয়েও আমাদের আর কোন ঘটনা বিপুলভাবে আঘাত করতে পারে? এটি তো কোন যুদ্ধক্ষেত্র ছিল না।
ছিল না কোন দু’দলের আদর্শিক সংঘর্ষ। তার ওপর স্থানটি দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী শিক্ষার্থীদের মানসম্মত উচ্চশিক্ষা গ্রহণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান! এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী ছাত্রের মৃত্যু ঘটেছিল, যে ছেলেটি গ্রামের দরিদ্র ঘরের সন্তান হয়েও মেধার জোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিল। তাও ছাত্রলীগ নামধারী খুনীদের অমানবিক, সহানুভূতিহীন র্যাগিংয়ের কারণে! জানি না সেই অপরাধীদের কোন বিচার হয়েছিল কিনা।
খবরের কাগজ সূত্রে জানতে পারছি, জেনে বিমূঢ় হচ্ছি, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বুয়েটের মতোই ‘টর্চার সেল’ আছে, যে কক্ষগুলোতে ছাত্রলীগের নামধারী নেতা-কর্মী ‘শিবির’-এর কোন সদস্য আছে কিনা, কোন ছাত্র প্রধানমন্ত্রীর কোন বক্তব্য, ছবিকে বিকৃত করা ইত্যাদিতে যুক্ত আছে কিনা, সেসব দেখার ভার তারা নিজেরা গ্রহণ করে। চুক্তির বিরুদ্ধে ফেসবুকে কমেন্ট, স্ট্যাটাস দেয়ার অপরাধের বিচারক সেজে বসা নেতারা মধ্যযুগীয় বর্বর পন্থা ব্যবহার করে অপরাধীদের নির্যাতন চালায়।
এই যখন উচ্চ শিক্ষার মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়মিত কাজ হয়, তা হলে একদিকে তারা মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যেমন আসুরিক শক্তি হয়ে ওঠে, তেমনি অন্যদিকে আগে যেমন দীর্ঘদিন বিএনপি-জামাতের শাসনামলে রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের খুনীদের দ্বারা রগকাটা, গলাকাটার কেন্দ্র হয়েছিল, সেটি পরিবর্তন হয়ে ‘শিবির’-এর ধারার দায়িত্ব নিয়ে ‘টর্চার সেল’ স্থাপন করে নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানের, মর্যাদার অবনমন করা হচ্ছে- এই তথ্য কি আওয়ামী লীগের প্রধান নেতাদের এতদিন জানা ছিল না? প্রশ্ন উঠেছে-
১. প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানÑ বুয়েট, রুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি, প্রধানত ভিসি, প্রো-ভিসি, হলের প্রভোস্ট, হাউজ টিউটরদের কেউ কি হলে ‘টর্চার সেল’ থাকা এবং অন্যায়ভাবে শিক্ষার্থীদের কেউ বিচারক বনে অন্য শিক্ষার্থীকে অপরাধী বানিয়ে নির্যাতন করার বিষয়টি জানতেন না?
২. হাত ভাঙ্গা, পা ভাঙ্গা, রক্তাক্ত-জখম হওয়া, শুনেছি দীর্ঘকাল ধরে এসব নির্যাতন চলেছে। তা হলে এসব ঘটনা প্রশাসকদের কেউ জানত না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কথা হলো, তাঁরা প্রয়োজনে শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, এমনকি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, প্রধানমন্ত্রীকেও জানানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। কিন্তু কি কারণে সে দায়িত্ব পালন করলেন না?
৩. কেন তাঁরা দিনের পর দিন এ অন্যায় ঘটতে দিয়ে ‘ছাত্রলীগ’ ‘আওয়ামী লীগ’ দলগুলোর উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ক্রমশ গুটি কয়েক মাস্তান দ্বারা ম্লান হতে দিলেন? কেন, কি উদ্দেশ্যে তাঁরা অন্যায় ব্যবস্থাটি চালু রাখতে দিলেন? অথচ আওয়ামী লীগের উচ্চ মহলকে সহজেই জানাতে পারতেন। কিন্তু ভিসি থেকে প্রভোস্ট-হাউজ টিউটর সবাই নীরব থাকলেন কেন?
৪. বুয়েট এবং প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা খুনী-নির্যাতক হয়ে ওঠে অথবা কোন ছাত্র খুনী-নির্যাতক ছাত্রের হাতে খুন হয়, নির্যাতিত হয়, আবার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করতে অক্ষম হয়Ñ সে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম কিভাবে বিশ্বের ভালমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় থাকবে?
৫. আমি আগেও লিখেছি- গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত ভিন্ন মত, নানারকম মতের অবস্থানকে গ্রহণ, প্রধানমন্ত্রীর ওপর কার্টুন ছাপা হওয়া যে কোন দেশেই প্রচলিত আছে। এটির প্রতি সহিষ্ণুতা প্রধানমন্ত্রীর আছে বলেই বিশ্বাস করি।
তবে মত প্রকাশের একটা সীমারেখা থাকবে, যা সব দেশেই আছে। আমরা এমন কোন ভ্রান্ত তথ্য বা এমন কোন মত, ছবি প্রচার করতে পারি না, যা আমাদের রাষ্ট্রের মূলনীতির বিরোধী এবং যে মত রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত করবে। যেমন- ইউরোপে নাজিবাদের সমর্থন আইনীভাবে দ-নীয় অপরাধ। তেমনই বাংলাদেশের গণহত্যার বিরোধিতা করা বা ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের অপরাধের সমর্থন, যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামী, শিবিরের রাজনীতি সমর্থন করা গণ্য হবে আইনী অপরাধ হিসেবে।
অন্যকে মত প্রকাশের অধিকারের সুযোগে রাষ্ট্রদ্রোহী বক্তব্য, মত প্রকাশ করা কোনমতেই কোন রাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্য হয় না। এখানে আমি একটি উদাহরণ দিতে চাই। ধরা যাক, প্রধানমন্ত্রী সদ্য ভ্রমণ করা ভারতের সরকারের সঙ্গে কয়েকটি চুক্তি করেছেন। সেগুলোর সমালোচনা করেছেন একজন নাগরিক। সেই সমালোচনায় যেসব ভুল আছে, সেটি ব্যাখ্যা করার সরকারের দায়িত্ব। যেমন- গ্যাস বিক্রির বিষয়টি ভুল ছিল।
সরকার আসলে এলএনজি বিক্রির চুক্তি করেছে। অর্থাৎ সমালোচনায় থাকা ভুল- এর সঠিক ব্যাখ্যা সরকারকে দিতে হবে এবং সেটি বক্তব্য আকারে দেয়া হয়েছে। কোন নাগরিক ফেনী নদীর পানি ভারতকে দেয়ার চুক্তির সমালোচনা করেছেন এ কারণে যে, তিস্তার পানি বাংলাদেশকে না দিলেও ভারতকে বাংলদেশের ফেনী নদীর কিছু পানি দিতে সরকারপ্রধান সম্মত হলেন কেন? এটির একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন।
ফেনী নদীর কয়েক কিলোমিটার পথ ত্রিপুরার সীমান্ত দিয়ে ভেতরে ঢুকে ঘুরে আবার বাংলাদেশে ঢুকেছে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, আমরা আমাদের গ্রামের বা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর পানি দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহার করি। এটি কেউ নিষেধ করতে পারে না। তেমনই ফেনী নদীর পানি দীর্ঘকাল ধরে ত্রিপুরার ওই অংশের মানুষ ব্যবহার করে আসছে, যা আমি, আপনি, সরকার বন্ধ করতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত কৌশলে ভারতের সরকারপ্রধানের সঙ্গে যে পানি ত্রিপুরার কয়েক গ্রামের মানুষ ব্যবহার করে আসছে সেটিকে চুক্তিতে এনে এবার মোদি সরকারকে তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দেয়ার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিতে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ ফেনী নদীর পানি দিলাম (আসলে এ পানি ওরা ব্যবহার করছে), এবার আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় তিস্তার পানি দিন। ফেনী নদীর পানি চুক্তির মাধ্যমে আসলে তিস্তা চুক্তির পক্ষে ভারতের ওপর চাপ বাড়ানো হলো!
মত প্রকাশের অধিকারের বিষয়ে আর একটি কথা বলতে চাই। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত যে শুধু এক কোটি বাঙালী গৃহত্যাগী মানুষকে খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা, আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছিল তা নয়, ত্রিপুরার বারো লাখ অধিবাসী আমাদের আঠারো লাখের বেশি মানুষকে হাসিমুখে সেই কঠিন সময়ে গ্রহণ করে সবরকম সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল। সর্বোপরি, আমাদের একটি প্রবাসী সরকার গঠন করতে দিয়ে, যুদ্ধ সরঞ্জাম, সেনা প্রশিক্ষণ, চিকিৎসাসেবা অকাতরে দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনকে বিরূপ বিশ্বে কতটা সহজসাধ্য করে দিয়েছিল তা আমরা যেন ভুলে না যাই।
আমরা ভুলে যাই প্রায় ষোলো হাজার ভারতীয় সেনা, যার মধ্যে অনেক উচ্চ পদাধিকারী সেনা কর্মকর্তা ছিলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন, যাদের রক্ত আমাদের ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে চিরকালের জন্য। সম্ভবত বুয়েটের অকাল প্রয়াত আমার সন্তানসম তরুণটি ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথাটি ভুলে গিয়েছিল, যেটি তার খুব ভাল ইতিহাস জ্ঞানকে অসম্পূর্ণ করে রেখেছে।
কথা হচ্ছে- ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিয়ে টর্চার সেল বন্ধ করা যাবে কি? আসলে দরকার হচ্ছেÑ
এক সময় আমরা বড় দলের অঙ্গ সংগঠন না হলেও দেশ ও শিক্ষার স্বার্থে সংগঠন করতাম। যেমন- ‘আমাদের সময় আমরা বলতাম- জলি আপার দল, মতিয়া- মেনন ভাই, মানিক ভাইয়ের দল করি আমরা।’ তার ফলে মুক্তিযুদ্ধের যাত্রাপথের লক্ষ্যে মিছিল-মিটিং করায়, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করায় কোন বাধা আসেনি। অবশ্য তখন জামায়াত-শিবির নামের কোন সন্ত্রাসী, দেশ-ভাষা ও সংস্কৃতিবিরোধী, আজকের বিজ্ঞানমনস্ক বিরোধী কোন দল, সংগঠন ছিল না।
এখন কথা হলো, প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে তো আবার এই জঙ্গী, খুনী, সন্ত্রাসীরা অবাধে তাদের কার্যক্রম চালাবে। উল্লেখ্য, ছাত্রদের খুনী হয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে আসলে র্যাগিংয়ের নামে। সুতরাং র্যাগিং নিষিদ্ধ করা, নিয়মিত হল পরিদর্শন করে ছাত্রদের ওপর নজর রাখতে হবে, সাবেক ছাত্রদের রাতে হলে না থাকা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধ করা গেলে ছাত্র রাজনীতি সুস্থ ধারায় অবস্থান করবে। এই বিশ্বাস আমাদের সবার আছে।
লেখক :মমতাজ লতিফ, শিক্ষাবিদ