মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ে দীর্ঘসূত্রিতায় প্রাথমিকে উপবৃত্তি বিতরণ ব্যাহত হওয়ার আশংকা

নিজস্ব প্রতিবেদক |

বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী সব শিশুর ভর্তি ও ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ এবং ঝরে পড়া রোধে ‘প্রাইমারি এডুকেশন স্টাইপেন্ড প্রজেক্টের আওতায় উপবৃত্তি প্রদান করে আসছে সরকার। উপবৃত্তি কার্যক্রমের শুরু থেকেই উপবৃত্তির অর্থ বিতরণ করা হতো সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এনালগ পদ্ধতিতে। শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত উপবৃত্তি কার্ডে তথ্য সংযুক্ত করে  অর্থ বিতরণে বিপুল অর্থের অপচয় ও অনিয়মের অভিযোগ ছিলো বিস্তর। এমন প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে উপবৃত্তি বিতরণের। এই লক্ষ্যে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে রুপালি ব্যাংক শিওরক্যাশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় চলতি ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে। কিন্তু শিওরক্যাশের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির অর্থ তুলতে নানা ধরণের অনিয়ম, ভোগান্তি ও শিক্ষকদের দিয়ে শিওরক্যাশের বিভিন্ন কাজ করিয়ে নেয়ায় অভিযোগ উঠে। এছাড়া শিওরক্যাশের নিম্নমানের প্রযুক্তি, ব্যালেন্স চেক করার জন্য একেক অপারেটরের যেমন বাংলালিংক, গ্রামীন, রবি, এয়ারটেল, টেলিটক এর অনেক ডিজিটের আলাদা আলাদা নম্বর যা  মনে রাখা কষ্টকর। অভিভাবক ও শিক্ষকদের কাছ থেকে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর শিওরক্যাশের সঙ্গে চুক্তিটি নবায়ন না করে উপবৃত্তি বিতরণে অধিকতর যোগ্য প্রতিষ্ঠান নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। এই পর্যায়ে বিকাশ, রকেটসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রস্তাব আহবান করে অধিদপ্তর। কিন্তু নতুন অর্থ বছরের পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও এই বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি অধিদপ্তর। ফলে ১ কোটি ত্রিশ লাখ শিক্ষার্থী অদ্যাবধি সেপ্টেম্বর মাসের উপবৃত্তির কিস্তির টাকা পায়নি। অধিকন্তু ডিসেম্বর মাসের কিস্তির উপবৃত্তির টাকাও সময়মত বিতরণ করা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়। দেশের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সময়মত উপবৃত্তি বিতরণ বাধাগ্রস্ত হলে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি এবং ঝরে পড়ার হার বেড়ে যাবে। তাই অনতিবিলম্বে কোন যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়ে কার্যক্রম শুরু করা উচিত।

প্রাথমিক শিক্ষা উপবৃত্তি প্রকল্পের পরিচালক ড. মহীউদ্দীন আহমদের দেয়া তথ্যমতে, সারাদেশের [মহানগরী বাদে] ৬০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেয়া হয়। এ জন্য বছরে সরকারের ব্যয় হচ্ছে আনুমানিক ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১লা মার্চ রুপালি ব্যাংক শিওরক্যাশের মাধ্যমে  প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক কোটি ত্রিশ লাখ শিক্ষার্থীর মায়েদের মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে উপবৃত্তির অর্থ পাঠানোর কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক বিনামূল্যে ১ কোটি সিম দিয়েছে উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীর মায়েদের। প্রতি অর্থবছরে চারটি কিস্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মায়েদের মোবাইল একাউন্টে উপবৃত্তি পৌঁছে দেওয়ার কথা থাকলেও শিওরক্যাশ শুরু থেকেই যথাসময়ে শুরু করতে ব্যর্থ হয়। অভিভাবক, প্রাথমিক শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, শিওরক্যাশের পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকা ফলেই এই বিপত্তি ঘটেছে।  অপ্রতুল এজেন্ট সংখ্যা, এজেন্টদের একাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা না থাকা  এবং টাকা তুলতে এজেন্টদের অতিরিক্ত অর্থ আদায় এবং কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে টাকা মেরে দেওয়ার মত ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ উঠেছে শিওরক্যাশের বিরুদ্ধে।

শিওরক্যাশের মাধ্যমে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের মোবাইলে উপবৃত্তির অর্থ বিতরণে অনিয়মের বিষয়াদি অবহিত করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গত ২২ জুন রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের জন্য  বরাদ্দ অর্থের চেয়ে কম দেওয়া। ৩০০ টাকার জায়গায় ১৫০ টাকা দেওয়া, মোবাইলে মেসেজ না যাওয়া, শিওরক্যাশের পর্যাপ্ত এজেন্টের অভাব, এজেন্ট কর্তৃক উপবৃত্তির অর্থ থেকে ১০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত অবৈধভাবে কেটে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া এসব সমস্যার সম্মুখীন হওয়া প্রধান শিক্ষকবৃন্দ সংশ্লিষ্ট উপজেলা শিক্ষা অফিসে গিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না বলেও জানিয়েছেন তারা।

চিঠিতে লোকবল সংকট, যথাযথ তদারকির অভাব এবং পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনার অভাবে মোবাইল ব্যাংকিং পদ্ধতির সুফল প্রাপ্তি থেকে উপকারভোগীগণ বঞ্চিত হচ্ছেন বলে উল্লেখ করা হয়।

ভোগান্তি সম্পর্কে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের শিক্ষক মো: মাসুদুর রহমান দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই থেকে উপবৃত্তির কিস্তির অর্থ প্রদান করতে শিওরক্যাশের প্রয়োজন হয়েছিল প্রতিজন সুবিধাভোগীর জন্য শিওরক্যাশের একাউন্ট খোলার। রুপালী ব্যাংক শিওরক্যাশের একাউন্ট খুলতে শিক্ষকদেরকে কাজে লাগিয়েছেন। দেখা গেছে, শিক্ষকরা শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ রেখে ৪/৫ দিন ধরে এক নাগারে এই শিওরক্যাশের একাউন্ট খোলার ফরম পূরণ করছেন। এর পরে আছে টপশিট তৈরি ও সংশোধন। এ এক মহা কর্মযজ্ঞ। অত:পর বিতরণ করা হয়েছিল জুলাই-ডিসেম্বর-২০১৬ কিস্তির উপবৃত্তির টাকা।

মাসুদুর রহমান আরও জানান, শিওর ক্যাশের মাধ্যমে উপবৃত্তি প্রদানে অনেক বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়। ভুলে ভরা শিওর ক্যাশের তথ্য আপডেট করতে হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষকরা। সকাল থেকে শুরু করে বিকেল পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে শ্রম দিয়ে সেই তথ্য নির্দিষ্ট ছকে সংযোজন ও সংশোধন করতে হয় তাদের। আবার দু’এক দিন পর পর নতুন নতুন ফরম্যাটে তথ্য প্রদান, যেন এক বিরক্তিকর অবস্থা। এ বিষয়ে বিভিন্ন তথ্যের জন্য শিক্ষা অফিসে যোগাযোগ করলে তারা কিছুই বলতে পারেন না। এভাবে ছোটাছুটি আর হয়রানির শিকার হতে হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরামের আহ্বায়ক মো: সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শ্রেণিকক্ষের পাঠদান বাদ দিয়ে শিওরক্যাশের কাজ করা অন্যায়, অবৈধ, শিক্ষার অপূরণীয় ক্ষতি।

তিনি বলেন, পুরনো পদ্ধতিতে উপবৃত্তি বিতরণে দুর্নীতি থেকে মুক্তি পেতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিতরণের সিদ্ধান্ত অবশ্যই ভালো। তবে, যাদের মোবাইল ব্যাংকিং করার অভিজ্ঞতা বেশি, যাদের বেশি সংখ্যক এজেন্ট রয়েছে, যারা কোনো সার্ভিস চার্জ নেয়না তাদেরকেই দায়িত্ব দেয়া উচিত।

যশোরের কেশবপুর উপজেলার বায়সা মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারি শিক্ষক বলেন,  বিকাশ, রকেট, এম ক্যাশ, ইউ ক্যাশে ব্যালেন্স চেক করার জন্য মাত্র তিন ডিজিটের একটি নম্বর। অপরদিকে শিওরক্যাশের ক্ষেত্রে  বাংলালিংক, গ্রামীণের আলাদা নম্বর। তাও আবার ১১ ডিজিটের, যা মনে রাখা কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

তিনি বলেন, শিওর ক্যাশের পদ্ধতিটাই এমন যাতে একজন শিক্ষক যাবে অভিভাবকের গোপন পিন নং জেনে ব্যালেন্স চেক করতে বা একজন এজেন্ট অভিভাবকের গোপন পিন জেনে টাকা ক্যাশ আউট করবে। এটা নিম্নমানের পদ্ধতি।

জানতে চাইলে শিওরক্যাশ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম দৈনিক শিক্ষাডটকমকে অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা বেশকিছু অভিযোগ পেয়েছি। সে অনুসারে কিছু কিছু সমস্যার আমরা প্রতিকার করেছি এবং অন্যান্যগুলোর বিষয়ে  আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত যাচাই বাছাই করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0060441493988037