ম্যালথাসবাদ ও আজকের পৃথিবী

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় প্রখ্যাত বৃটিশ জনসংখ্যাবিদ ম্যালথাসের একটি তত্ত্ব পড়েছিলাম। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে তার ‘প্রাকৃতিক নিরোধ’ কথাটি তেমন একটা বিশ্বাস হয়নি। আজ যখন পৃথিবীতে করোনা মহামারিতে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, তখন সেটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।

ম্যালথাসবাদে জনসংখ্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে যুক্তিসঙ্গত আলোচনা হয়েছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে ম্যালথাস প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুনরায় কাম্য জনসংখ্যায় ফিরে আসার বিষয়ে জোর দেন। তাঁর মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে এক সময় সম্পদ ও জনসংখ্যার মধ্যে পার্থক্য দেখা দেবে। এভাবে দীর্ঘদিন জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে এক সময় প্রকৃতি অতিরিক্ত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে এগিয়ে আসবে। তখন নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারি দেখা দেবে। দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, ভূমিকম্প, মহামারি ইত্যাদি নানা কারণে মানুষ মারা যাবে। তাতে করে সম্পদ ও জনসংখ্যার মধ্যে পুনরায় ভারসাম্য ফিরে আসবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ এবং বিভিন্ন সময়ে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ করোনা ভাইরাস সংক্রমণে বিশ্বে বহু মানুষের মৃত্যু প্রায় আড়াইশ বছর আগের ম্যালথাসবাদকে সামনে নিয়ে এসেছে। সঙ্গত কারণে আজ ম্যালথাসের থিওরিটি সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। এমনিতে ফি বছর দুর্ঘটনা, খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্পসহ নানা দুর্যোগজনিত কারণে বহু লোক মারা যায়। এদিক থেকেও ম্যালথাসের প্রাকৃতিক নিরোধ কথাটিকে অবিশ্বাস কিংবা সন্দেহ করার কারণ নেই। তবে সব মৃত্যু প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণের হিসেবের মধ্যে পড়ে না। স্বাভাবিক মৃত্যু অবশ্যই নয়। নানা কারণে পৃথিবীতে প্রতিদিন কয়েক হাজার লোক মারা যায়।

প্রতিদিনের স্বাভাবিক মৃত্যু গণনা করলে কয়েক হাজার হবে। বিভিন্ন দুর্ঘটনা কিংবা আগের পুরনো রোগেও লোক মারা যায়। এখন মনে হয় এসব মৃত্যুর কেউ আলাদা হিসেব করে না। বর্তমানে কেবল করোনা আর করোনা। সব মৃত্যুর হিসেব করোনার হিসেবের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে- সব মৃত্যুর একটিই কারণ ‘করোনা’। যে কোনো রোগী আজ সর্দি-জ্বর নিয়ে অন্য রোগে মারা গেলেও সে করোনায় মৃতের সংখ্যার সাথে যোগ হয়ে যাচ্ছে। এ রকম করে মৃত্যুর মিছিলটাকে বড় করে দেখানোর খেলা কারা শুরু করেছে, কে জানে? এতে দিন দিন আতঙ্ক বেড়ে চলেছে। আতঙ্কে আতঙ্কে ভরে যাচ্ছে দুনিয়া। কেঁপে উঠছে দুনিয়ার মানুষজন। আমাদের এখানেও সেটিই হচ্ছে। আগে আইইডিসিআর এবং এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সে রকম আপডেট দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেও এভাবে খবর প্রচার হচ্ছে। এ রকম করে এমন একদিন আসবে, যেদিন করোনার চেয়ে এর আতঙ্ক বড় হয়ে উঠবে। কেউ কেউ আতঙ্কে মারা যাবে।

করোনার অস্তিত্ব কিংবা ভয়াবহতা নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন বা সন্দেহ নেই। করোনা ভাইরাস আজ সারা বিশ্বে মহামারির রূপ নিয়েছে তাতেও দ্বিমত নেই। কিন্তু প্রতিদিন ‘ওয়ার্ল্ড অমিটারস’ ওয়েব সাইটসহ নানা সংবাদ মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে করোনায় মৃত্যুর যে আপডেট দেয়া হয়, তা নিয়ে আমার কিছু সন্দেহ আছে। পৃথিবী জুড়ে করোনা ভাইরাস নিয়ে কেউ কোনো কৃত্রিম আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টায় রয়েছে কি না, সে প্রশ্নটি মনের ভেতর উঁকি দেয়। আজ যে কারণে সন্দেহটি আরেকটু বেশি হয়েছে, সেটি বলার জন্য এই প্রয়াস। 

প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে করোনা মহামারির আপডেট জানার জন্য দৈনিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট ভিজিট করি। ইন্টারনেট, ফেসবুক ঘেঁটে ঘেঁটে করোনার আপডেট খুঁজি। ইউরোপ আমেরিকাসহ পৃথিবীর নানা দেশে স্বজনেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সে কারণে প্রতিদিন করোনার আপডেট খুঁজে খুঁজে দেখি। বিভিন্ন দেশে প্রতিদিন মৃত্যুর হিসেব লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে দেখে আতঙ্কিত হই। তাদের জন্য দোয়া করি। অজানা এক আতঙ্কে দিন কাটে। ফ্রান্সে গতকাল ১৩৫৫ জন করোনায় মৃতের সংখ্যাটি ১ওয়ার্ল্ড অমিটারস’ সাইটে দেখে আরও আতঙ্কিত হই। আমার এক খালা ছেলে ও নাতিপুতি নিয়ে ফ্রান্সের প্যারিসে বসবাস করেন। কয়েকজন পুরনো ছাত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষী ফ্রান্সে চাকরি ও লেখাপড়া করে। একমাত্র ছেলেটি বৃটেনের বার্মিংহাম শহরে থাকে। সে জন্য দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যায়। দুশ্চিন্তা থেকে আতঙ্ক। এর আগের দিন মৃতের সংখ্যা সাতশ  কতজন জানি দেখলাম। আজ ১৩৫৫ জন। আগের দিনের প্রায় দ্বিগুন। খবরটি কতটুকু সঠিক, তা জানার জন্য বিভিন্ন জনের সাথে যোগাযোগ করি। ফেসবুক ঘাটাঘাটি করি। নেটে ঘুরি। অবশেষে সন্দেহের জায়গায় পৌঁছে যাই।

প্রকৃতপক্ষে ফ্রান্সে গতদিন করোনায় ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ৪৭১ জন। বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রমে গত ২-৩ সপ্তাহে মারা গেছে ৮৮৪ জন। করোনায় মৃত ৪৭১ জনের সাথে ২-৩ সপ্তাহে বৃদ্ধাশ্রমে মৃত ৮৮৪ জনকে যোগ করে ১৩৫৫ জন হয়েছে। কী আশ্চর্য গোলমেলে হিসেব? বৃদ্ধাশ্রমে যারা থাকে, তারা অতিশয় বৃদ্ধ মানুষ। নানা রোগে-শোকে ভোগে। তাদের অনেকের মারা যাবার বয়স হয়েছে। কেউ কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়েও মারা যেতে পারে। তাই বলে বৃদ্ধাশ্রমের মৃতদের করোনায় মৃত দেখাতে হবে কেন? তাও আবার বৃদ্ধাশ্রমগুলোর ২-৩ সপ্তাহের হিসেব। হাঁসবো না কাঁদবো, ভেবে পাই না।

ফ্রান্সের বহুল প্রচারিত ‘লো পারিজিয়ান’ পত্রিকা ও ‘বিএফএম’ টেলিভিশন সূত্রে এর সত্যতা নিশ্চিত হয়ে ফ্রান্সে বসবাসকারী স্বজনের জন্য কিছুটা নিশ্চিন্ত হই। সংবাদ মাধ্যমগুলো করোনা ভাইরাসে মৃতের সঠিক হিসেব জানাতে না পারলে আপডেট নিউজ প্রচার করার দরকার নেই। এসব গোঁজামিল হিসেবে কেবল আতঙ্ক ছড়ায়। এখন থেকে করোনায় মৃতের আপডেট দেবার সময় কতজন স্বাভাবিক মৃত্যু কিংবা করোনা ছাড়া অন্য রোগে মারা গেছে সেই হিসেবটি দিলে করোনার প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে। তা না হলে করোনার চেয়ে এর আতঙ্ক ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। আতঙ্কে গোটা পৃথিবীর অপূরণীয় ক্ষতি হবে। করোনা মহামারির চেয়ে এর আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে বহুদিন লেগে যাবে।

আতঙ্ক আরেক রোগ বা মহামারির নাম। আতঙ্কে অনেকের প্রাণহানি ঘটতে পারে। বৃদ্ধ কিংবা হার্টের অনেক রোগী আতঙ্কে মারা যেতে পারে। ‘আতঙ্কিত হবেন না’- এরকম একটি সতর্ক বার্তা প্রায়শ শোনা যায়। এ থেকে আতঙ্কের ভয়াবহতার বিষয়ে অনুমান করা খুব সহজ। সেদিন এক বিজ্ঞান ফিকশন বইয়ে পড়লাম- দু’ একটি প্রজাতি ছাড়া বেশিরভাগ সাপের কোনো বিষ নেই। তাহলে সাপের কামড়ে মানুষ মরে কেন? প্রশ্নটির উত্তর এরকম- সাপের কামড়ে বিষের চেয়ে আতঙ্কে বেশি লোক মারা যায়।

করোনা ভাইরাস ও মহামারির আতঙ্ক ইতোমধ্যে পৃথিবীকে গ্রাস করে বসেছে। এই মরণঘাতি ভাইরাসের সংক্রমণ ও আতঙ্ক দুটোই সমান গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। উভয়ের বিস্তার রোধে আজ সমন্বিত প্রয়াস অপরিহার্য। করোনা মহামারি প্রতিরোধে সার্ক অঞ্চলের রাষ্ট্রপ্রধানরা যেমন নিজেদের মধ্যে টেলিকনফারেন্স করে করণীয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, তেমনি বিশ্ব নেতাদেরকে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে করণীয় নির্ধারণ করে বৈশ্বিক এ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে কে জানে পৃথিবী নামের গ্রহে একদিন মানুষকে হয়তো ডাইনোসরের ভাগ্য বরণ করতে হবে। মানুষ প্রকৃতিকে হাতের মুঠোয় এনেছে-এমন দম্ভ পরিহার করা দরকার। এখনও মানুষ প্রকৃতির হাতে নিছক এক খেলার পুতুল।

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0070710182189941