যত উন্নতি হচ্ছে তত বাড়ছে বৈষম্য : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

হাতের কাজ বহুমাত্রিক। হেন কাজ নেই যেটি হাত ছাড়া সম্ভব। হাত তোলাটাও হাতের একটা ব্যবহার বৈকি। হাত তুলে সম্মতি জানানো, আত্মসমর্পণ করা, নিজের অস্তিত্ব জানানো ইত্যাদি কাজ করা যায়। অস্তিত্ব জানানোর ব্যাপারে একটি ছবির কথা মনে পড়ে। অত্যন্ত পরিচিত ছবি; একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের। সেখানে দুই পক্ষের দুই জেনারেল আছেন, ভারতের পক্ষে জগজিৎ সিং অরোরা, পাকিস্তানের পক্ষে এ এ কে নিয়াজি। থাকার কথা ছিল বাংলাদেশের পক্ষে আতাউল গনি ওসমানীরও। তিনি ছিলেন না। তাঁর বদলে ছিলেন এ কে খন্দকার। ঘটনার একাধিক ছবি এখন পাওয়া যাচ্ছে। সব ছবিতেই দৃশ্য প্রায় অভিন্ন। খন্দকার আছেন, তবে সামনে নয়, পেছনে। বসে নয়, দাঁড়িয়ে। একটি ছবিতে খন্দকারের মুখের সঙ্গে হাতও দেখা যাচ্ছে। পুরো হাত নয়, বাঁ হাতের কয়েকটি আঙুল। ভারতীয় ও পাকিস্তানি সেনাপ্রধানরা সবাই ছিলেন ইউনিফর্মে; খন্দকার সিভিল ড্রেসে। বহস্পতিবার (২ এপ্রিল) কালের কণ্ঠ প্রত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, যদি বলা হয় যে খন্দকারের ওই বিপন্ন হাত দুটির ভেতরে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ছবি ধরা পড়েছিল তা হলে সেটা হয়তো অতিশয়োক্তি হবে না। বাংলাদেশ কোণঠাসা হয়ে পড়বে, বিজয়ের মুহূর্তের ওই ছবিটি যেন ছিল তারই একটি বিষণ্ন পূর্বাভাস। তা কে করল কোণঠাসা? ভারতের কথা আলাদা করে বলা নিষ্প্রয়োজন। বড় প্রতিবেশী ছোট প্রতিবেশীকে এক কোণে ঠেলে দেবে—এতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। আসলে কিন্তু ভারত নয়, জব্দ করেছে পুঁজিবাদ। গোটা পুঁজিবাদী বিশ্ব এবং পুঁজিবাদী মতাদর্শই বাংলাদেশকে জব্দ করেছে এবং করে চলেছে, যে যেমনভাবে পারে। ভারত ওই পুঁজিবাদী বিশ্বেরই অংশ। আমাদের নদীতে এখন পানির যতই অভাব থাক, বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিষাক্ত পানির একূল-ওকূল দুকূলপ্লাবী অবস্থা, পানির কোনো অপ্রতুলতা নেই। অধিকাংশ মানুষই তাতে বিপন্ন; অল্প কিছু মানুষ ভাসছে, তারা ভাবছে—বেশ একটা আমোদ-প্রমোদে রয়েছে।

পুঁজিবাদের আগ্রাসনে পর্যুদস্ত। বাংলাদেশে এখন যত উন্নতি হচ্ছে, তত বাড়ছে বৈষম্য। বেকার ও অর্ধবেকারে ভরে গেছে দেশ। স্বৈরশাসন, মাদকাসক্তি, জঙ্গিপনা, খুনোখুনি, হানাহানি, ধর্ষণ, গণধর্ষণ—এসব পুঁজিবাদেরই অবদান। ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা টাকা রাখছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে, সে টাকা লোপাট করে দিচ্ছে স্বদেশি দুর্বৃত্তরা। দেশ থেকে সম্পদ পাচারে কোনো বিরাম নেই। অমানুষিক পরিশ্রম করে মেহনতিরা বিদেশ থেকে টাকা পাঠায়, সে টাকা হাতিয়ে নিয়ে চলে যায় বিদেশি প্রতারকরা। কারখানায় শ্রমিক হত্যার ব্যাপারে বাংলাদেশি মালিকরা বিশ্বরেকর্ড বিনা ক্লেশে ভঙ্গ করে ফেলেছেন। দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আমরা দাঁত বের করে হাসছি। ঋণখেলাপিতে আমাদের ধনীরা অন্ততপক্ষে এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে। বায়ুদূষণে রাজধানী ঢাকা এখন বিশ্বসেরা। ঢাকা এখন মনুষ্য বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।

আমাদের সব সম্পর্কই এখন পণ্যে পরিণত হওয়ার পথে, পুঁজিবাদ ঠিক যেমনটি করতে চায়। রাষ্ট্রীয় সেবা বলতে যা কিছু ছিল, তা বিলুপ্তির পথে ধেয়ে চলেছে। টাকা ছাড়া চিকিৎসা নেই। শিক্ষাও নেই। সরকার বলেছিল, কোচিং সেন্টারের ব্যবসা বন্ধ করে তবে শান্ত হবে; এখন দেখা যাচ্ছে কোচিং ব্যবসাকে সরকার শুধু যে ছাড় দিচ্ছে তা নয়, তাকে ছায়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দিয়ে দিয়েছে। ছায়া এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে কায়াতে পরিণত হওয়ার। বাস্তবতা হচ্ছে, গতি ওই দিকেই। একটি সংবাদপত্র হিসাব করে দেখিয়েছে, স্কুল পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীর পেছনে পরিবারের যে পরিমাণ ব্যয় হয়, তার শতকরা ৭৫ ভাগ যায় কোচিংয়ের পেছনে। পাঠ্যপুস্তকে হেফাজতি আগ্রাসন আমরা টের পাচ্ছি। সম্প্রতি তারা শিক্ষাক্রম থেকে বিবর্তনবাদ এবং কাদিয়ানিদের নিষিদ্ধকরণের জোরালো দাবি তুলেছে। বিশ্বব্যাংক হেফাজতি নয়, তারা সামন্তবাদের বিরোধী, শতভাগ পুঁজিবাদী; কিন্তু তারাও আমাদের শিক্ষাপ্রবাহকে দূষিত করার কাজে হাত লাগিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণে সৃজনশীল পদ্ধতি নামে এমন এক অভিনব পঠন ও পরীক্ষাপদ্ধতি চালু করা হয়েছে, যার দৌরাত্ম্যে উত্পীড়িত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক—সবাই অসহায়রূপে কোচিং সেন্টার ও গাইড বুকের খোঁজে ছোটাছুটি করতে বাধ্য হচ্ছে। সৃজনশীলের ধাক্কাটা কত দূর গড়াবে কে জানে।

একুশে ফেব্রুয়ারি এলে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন ও বাংলা ভাষার উন্নয়ন বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞাসা জেগে ওঠে, যেটা খুবই স্বাভাবিক ও প্রাসঙ্গিক। বাংলা প্রচলন বিঘ্নিত হচ্ছে, প্রচলনের ক্ষেত্রে গুণগত উন্নয়ন ঘটছে না। কিন্তু অসুবিধাটা কোথায়? অসুবিধাটা কিন্তু নিহিত পুঁজিবাদের ওই দুঃশাসনেই। পুঁজিবাদের ভাষা বাংলা নয়, সে ভাষা আপাতত ইংরেজি; এটা তাই খুবই স্বাভাবিক যে ইংরেজি ভাষা বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে চাইবে। ব্রিটিশ আমলে চেয়েছে, পাকিস্তান আমলেও চেয়েছে, এখনো চাইছে। লোক বদল হয়েছে, নীতির বদল হয়নি।

বাংলা ভাষার উত্কর্ষ বিধানের দায়িত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বাংলা একাডেমির। তা বাংলা একাডেমি ভালো কাজ কিছু কম করেনি। একাডেমির ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছর জমজমাট বইমেলা হচ্ছে, যাকে লোকে বলছে প্রাণের মেলা। সভা, সম্মেলন, ফেস্টিভাল, সম্মাননা প্রদান, উৎসব—এসব উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তবে বাংলা ভাষার উত্কর্ষ বিধানের জন্য তিনটি ক্ষেত্রে আরো অধিক কাজের প্রয়োজন ছিল। ক্ষেত্র তিনটি হলো—গবেষণা, অনুবাদ এবং উচ্চস্তরে শিক্ষা দান ও গ্রহণের উপযোগী গ্রন্থ প্রণয়ন। অভিযোগ রয়েছে যে বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগারে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ আছে; কিন্তু গ্রন্থাগারকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। একাডেমি বেশ কয়েকটি অভিধান প্রণয়ন করেছে। এ কাজটি ছিল জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অভিধান তৈরির ব্যাপারে একাডেমি একটি খুব অন্যায় ও ক্ষতিকর কাজ করেছে; সেটা হলো ‘ ী’ কারকে জব্দ করা, অনেক ক্ষেত্রে জবরদস্তিমূলকভাবে তাকে বিতাড়ন করা। ফলে শ্রেণী, চাষী, দাবী, গ্রন্থাবলী—এসব শব্দ তাদের অত্যাবশ্যকীয় দীর্ঘত্ব হারিয়েছে। একাডেমির নিজের বানান এখন ‘ ী’ কার খুইয়ে হ্রস্বইকার হয়ে পড়েছে, এবং এর জন্য একাডেমিকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত দৌড়াতে হয়েছে, আইনের সংশোধন করানোর আবশ্যকতায়। বাংলা একাডেমি সংসদীয় আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান, এবং আইনটির লিপিবদ্ধ বানানে ‘ ী’ ছিল, জোর করে ‘ ি’ বসানো হলো।

বাংলা বানানের ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপের চেষ্টা পাকিস্তানি শাসকরা করেছিল। সফল হয়নি। আমরা বাধা দিয়েছি। ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ নামে শামসুর রাহমান একটি মর্মস্পর্শী কবিতা লিখেছিলেন; সেখানে যে আর্তধ্বনি শোনা গিয়েছিল, সেটি শুধু বর্ণমালার একার ছিল না, ছিল সব বাঙালির। বাংলা একাডেমির নেতৃত্বে এখন কর্তনের ওই কাজটি বিনা বাধায় সুসম্পন্ন করা হয়ে গেছে; আর্তকণ্ঠকে মূর্ত করে তুলবেন এমন কবির সন্ধান আর পাওয়া যায়নি। বাংলা ভাষার লেখক ও সাধকরা এখন নিজেরা লিখবেন নাকি রচনার বানান ‘শুদ্ধ’ করবেন, এ নিয়ে একটা অস্বস্তির ভেতরে পড়েছেন।

বানান বিপ্লবের এই ধারণাটা আমাদের নিজেদের উদ্ভাবন নয়, এসেছে পশ্চিম—অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ থেকে। পুঁজিবাদী অগ্রগতিতে সর্বত্রই পশ্চিম আমাদের পূর্বগামী। পশ্চিমবঙ্গের পুঁজিবাদীদের অঙ্গীকারবদ্ধ মুখপত্র হচ্ছে একটি দৈনিক পত্রিকা; পত্রিকাটির কর্তৃপক্ষ দেখতে পাচ্ছিল যে ‘ ী’ কার নিয়ে তাদের খুবই অসুবিধা। লাইনো টাইপে তাঁরা অক্ষর সাজান ‘চাষী’, দেখেন মেশিনের চাপে ভেঙে গিয়ে ছাপা হয়েছে ‘চাষা’; সাজানো ‘রচনাবলী’ হয়ে যায় ‘রচনাবালা’। ‘ ী’ কারের এই ভয়ংকরতা দেখে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ঠিক করলেন ঝামেলা রাখবেন না, শেষের ‘ ী’ কারগুলোকে ভেতরে টেনে এনে ‘ ি’ কার করবেন; সেটা করতে গিয়ে দেখলেন আরো এগোনো যায়, ভেতরের ‘ ী’ কারও হটানো সম্ভব। সেই হস্তক্ষেপটা ঘটল, ফলে অত বড় দেশ ‘চীন’ হয়ে গেল ‘চিন’। এতে চিন চিন ব্যথা সে অনুভব করেছে কি না জানা যায় না, কেননা কান পেতে শোনার মতো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নেই। ধ্রুপদী ‘গ্রীসে’রও একই দুর্দশা; সে-ও তার দীর্ঘত্ব হারিয়ে লজ্জায় পড়েছে। পুঁজিবাদ সংবেদনশীলতা পছন্দ করে না, এবং ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’র ন্যায় গীতির প্রতিষ্ঠাকে ব্রত বলে জানে।

পুঁজিবাদ কোনো রকমের ছাড় দেবে না। সে যত দূর নামা সম্ভব নামবে। কিন্তু আমরা যারা ভুক্তভোগী তারা কী করব—প্রশ্ন সেটাই। রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা বিশ্বব্যাপী চলছে, চলবে আমাদের দেশেও। আন্দোলনটা বামপন্থী দেশপ্রেমিকদের করার কথা। তারা করেছে এবং এখনো করছে। কিন্তু সে আন্দোলন বিস্তৃত হয়নি, গভীরও হয়নি। না হওয়ার পেছনে অবশ্যই কারণ রয়েছে। একটা কারণ আন্দোলন করার কথা মেধাবী যে তরুণদের, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদী বিশ্ব তাদের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে উদার হস্তে নিজেদের প্রশস্ত বক্ষে টেনে নিয়েছে এবং নিচ্ছে। পাশাপাশি যারা বামপন্থায় টিকে থাকতে চাইছে, তাদের বঞ্চিত তো অবশ্যই, হেনস্তা করতেও ছাড়ছে না।

 লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি - dainik shiksha পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0059800148010254