যা প্রশ্ন ফাঁসের সুবিধাভোগীদের অসাধ্য

ড. মো. রিজওয়ানুল ইসলাম |

প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এমনকি বিভিন্ন চাকরির যোগ্যতা নির্ধারণী পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের এই মহোৎসবে এ দেশের অসংখ্য মানুষের মতো একজন শিক্ষক ও অভিভাবক হিসেবে আমিও ক্ষুব্ধ এবং মর্মাহত। বেশ কিছু দিন আগে থেকে যখন এসএসসি বা এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস শুরু হয়, তখন তবুও একটা সান্ত্বনা ছিল অন্তত বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাটি এ জঘন্য অভিশাপ থেকে মুক্ত। কিন্তু আজ যখন প্রায় সর্বস্তরেই এ দুঃখজনক বিষয়টির মহোৎসব শুরু হয়েছে এবং শিক্ষামন্ত্রী পর্যন্ত এই বিষয়ে তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করে কিছু শিক্ষককে দুষছেন, তখন এই বিষয়ে হতাশা বাড়ে বৈ কমে না। তবে আমার এই লেখার বিষয়বস্তু হচ্ছে প্রশ্ন ফাঁসকারীদের সাময়িক অবৈধ অর্জন সত্ত্বেও তাদের এ দুর্বৃত্তপনার দেউলিয়াত্ব এবং এখনও এ দেশে লাখ লাখ সৎ ছাত্রছাত্রী বা চাকরিপ্রার্থীর থেকে তাদের সুস্পষ্ট ব্যবধানে পিছিয়ে থাকার মতো কিছু বিষয়ের অবতারণা করা। এর মাধ্যমে আমি এটা বলতে চাচ্ছি না যে, যেসব দুর্বৃত্ত প্রশ্ন ফাঁস করার সঙ্গে জড়িত বা যেসব শিক্ষার্থী বা চাকরিপ্রার্থী এই দুর্বৃত্তপনার সুবিধাভোগী, তারা কোনো অপরাধ করছে না বা তাদের অপরাধকে লঘু করে দেখা উচিত। কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রের এই নিষ্ঠুর এবং প্রায় অপ্রতিরোধ্য অপরাধকে লঘু না করেও এটি বলা যায় যে, প্রশ্ন ফাঁসকারীদের কিছু নগদ প্রাপ্তি সত্ত্বেও তারা যা হারাচ্ছে তার মূল্যটিও কম নয়। আপাতদৃষ্টিতে এই দুর্বৃত্তপনার সুবিধাভোগীদের অর্জন যত বড় মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে তাদের অর্জন তার চেয়ে কম।

আজ যেসব শিক্ষার্থী এই অবৈধ প্রক্রিয়ার সুবিধাভোগী, তাদের কথা ভাবলে আমার বগুড়া জিলা স্কুলের শিক্ষাজীবনের কথা মনে পড়ে। এটি একটি তিক্ত সত্য যে, আজ থেকে বিশ বছর আগেও আমাদের বগুড়া জিলা স্কুলের মতো উত্তরবঙ্গের একটি ঐতিহ্যবাহী স্কুলও প্রশ্ন ফাঁসের এই মহামারীমুক্ত ছিল না। আমি নিশ্চিত, আমার সেদিনের প্রায় সব সহপাঠীই আজ আমার সঙ্গে সহমত হবে যে, যখন এই অনৈতিক বিষয়টি নিয়ে সারাদেশে তেমন কোনো শোরগোল ছিল না, তখনও আমাদের কিছু সহপাঠী এই দুর্বৃত্তপনার সুবিধাভোগী ছিল।

আমাদের স্কুলের একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, আবু সীনা স্যার আমাদের প্রাইভেট পড়ানোর (হ্যাঁ, তার মতো সৎ মানুষকেও জীবনের তাগিদে প্রাইভেট পড়াতে হতো) সময়ে প্রশ্ন ফাঁসের ফলে আমরা যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিলাম না, তাদের পিছিয়ে পড়ার হতাশা দেখে বলতেন, ‘দুর্বৃত্ত হওয়া সহজ ব্যাপার, ভালো হওয়াটা নয়। প্রশ্ন ফাঁস করে তোরা কিছু পরীক্ষা উতরাতে পারিস, অনেক পরীক্ষাতেই বিশেষ করে যে পরীক্ষার ওপর জীবনে অনেক কিছু অর্জন করার ব্যাপার থাকবে, সেখানে কিছুই করতে পারবি না। আর জীবনের পরীক্ষায় অবশ্যই ফেল করবি।’ স্যারের কথা তখন কতকুটুই-বা বুঝতাম? তার দৃঢ় বিশ্বাস থেকে বলা কথা আমি বা আমার বন্ধুরা হয়তো বুঝতাম না; তবে তাকে অবিশ্বাস করার মতো দুঃসাহস অন্তত আমার ছিল না। যে বিশ্বাসের পেছনে উপলব্ধি নেই, তাকে বোধ করি অন্ধবিশ্বাসই বলা চলে। হোক সে অন্ধবিশ্বাস, আজ এতদিন পর বুঝতে পারি যে, সেই বিশ্বাসটা ভুল ছিল না।

কিছু কিছু পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস করে ভালো ফল অর্জন করে কিছু ভর্তি পরীক্ষায় বসার যোগ্যতা অর্জন করা বা সেই ভর্তি পরীক্ষায় কিছু বাড়তি স্কোর করা সম্ভব। কিন্তু অনেক যোগ্যতা নির্ধারণী পরীক্ষা ঝঅঞ, এজঊ, এগঅঞ, ঞঙঊঋখ, ওঊখঞঝ বা এমনকি আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ ভর্তি পরীক্ষার কিছু সংখ্যক জায়গাতেও প্রশ্ন ফাঁসের সুবিধাভোগীরা উতরাতে ব্যর্থ হবে। বিভিন্ন ফাঁকফোকরে জালিয়াতি করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি হওয়া এসব শিক্ষার্থী যদি কোনোভাবে বিশ্বের সেরা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতেও পারে, এই সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ যে, তারা সেসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাফল্যের সঙ্গে উতরাতে পারবে। একজন আইনের ছাত্র হিসেবে আধুনিক বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি সম্পর্কে আমার ধারণা নেই বললেই চলে। তবুও এটা নিরাপদেই বলতে পারি, শিক্ষার কোনো শাখায় প্রশ্ন ফাঁসের মতো শর্টকাট পদ্ধতি অনুসরণ করে সফলতা অর্জনের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। বিভিন্ন পেশাগত শিক্ষা, যেমন- প্রকৌশল, চিকিৎসা, সাংবাদিকতা, অ্যাকাউন্টিং, আইন ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রশ্ন ফাঁসের সুবিধাভোগীদের জ্ঞানের দৈনতা প্রকটভাবে উন্মোচন হওয়ার এবং পেশাগতভাবে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

উচ্চশিক্ষার চূড়ান্ত উৎকর্ষ ধরা হয় গবেষণাকে। একজন একাডেমিক গবেষক হিসেবে এটা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, গবেষণার ক্ষেত্রে প্রশ্ন ফাঁস বা নকলের সুযোগ নেই। একজন গবেষকের সামনে পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞানভাণ্ডারই উন্মুক্ত থাকে; কিন্তু একজন সফল গবেষককে এই জ্ঞানভাণ্ডার থেকে নতুন জ্ঞানের জন্ম দিতে হয়। তাই প্রশ্ন ফাঁসের মতো শর্টকাট এখানে ষোলো আনাই অচল। এমনকি এমফিল বা পিএইচডি ছাড়াও মাস্টার্স পর্যায়ে ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং সৃজনশীলতা ছাড়া সাফল্য কখনোই সম্ভব নয়। তাই চুরির সুবিধাভোগীরা উচ্চতর গবেষণায় সফল হবে এ বড় দুরাশা।

তাই প্রশ্ন ফাঁসের হতাশাজনক এই মহোৎসবের সময় এ দেশের লাখ লাখ সৎ শিক্ষার্থীর উদ্দেশে বলতে পারি, প্রশ্ন ফাঁস করে নম্বর বা চাকরি পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু শিক্ষার্জন বা জ্ঞানার্জন সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। পেশাগত জীবনে বা অন্য ক্ষেত্রে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বেশিরভাগ সময়ে আপাতদৃষ্টিতে দুর্বৃত্তরা জয়ী মনে হতে পারে; কিন্তু জীবনে এমন কোনো সময় আসতে পারে, যখন তাদের এই দুর্বৃত্তপনা বা অবৈধ সুবিধাভোগের জন্য মূল্যও দিতে হতে পারে। সস্তায় বা সহজে পাওয়া অর্জন জীবনে খুব কম সময়ই মূল্যবান, জীবনে যা কিছু অমূল্য, তা যথাযথ মূল্য দিয়েই পেতে হয়।

সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: সমকাল


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028679370880127