এই তো ক’দিন আগেই আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলাম। আমরা নিজ অর্থে পদ্মা সেতু বানাচ্ছি, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। হ্যাঁ, আমাদের জিডিপি বাড়ছে। আমরা উন্নত হচ্ছি এটাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নাই যে, শিক্ষা ও গবেষণা খাতে সর্বনিম্ন ব্যয় করে কেবল বাংলাদেশই। এই খাতে মোট জাতীয় আয়ের দশমিক এক শতাংশও বরাদ্দ থাকে না। বিশ্বের মানসমপন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি গবেষণাকে প্রাধান্য দিলেও আমাদের দেশে গবেষণা খাত সবচাইতে অবহেলিত।
আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা এখন সস্তা জনপ্রিয়তায় পরিণত হয়েছে। যার ফলাফল আমরা স্বচক্ষে দেখছি। গবেষণা খাতের বেহাল দশা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড র্যাাংকিং সেগুলোর আদর্শ প্রমাণ হিসেবে রাখা যায়। সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারেকাছেও তো যেতে পারিনি বরং অনেক দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ের যোগ্যতাই অর্জন করতে পারে না। বড় লজ্জার বিষয়।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা কেন নতুন কিছু উদ্ভাবন করে বিশ্বকে তাক লাগাতে পারি না? আমরা কেন অন্য দেশগুলোর উদ্ভাবন নিয়ে মাথা ঘামাই? আমরা কেন ভালো কিছুর জন্য উন্নত দেশগুলোর দিকে চেয়ে থাকি? আমরা কেন গবেষণায় বিশ্বের রোল মডেল হতে পারি না? আমরা কেন উদ্ভাবনে এত পিছিয়ে?
চীনের কথা না বললেই নয়। দেশটি কয়েক দশক আগেও অনেক পিছিয়ে ছিল। সেই চীন আজ উদ্ভাবন খাতে এতটাই এগিয়ে গেছে যে সারা বিশ্বের প্রত্যেকটি প্রান্তে তারা তাদের উদ্ভাবন ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বের অর্থনীতির অনেকটাই তারা নিয়ন্ত্রণ করে। শুধু তাই নয় তারা এখন বিশ্বের নানা প্রান্তে বিনিয়োগ করেই চলেছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ তাদের শিক্ষা ও গবেষণা খাত।
আমাদের দেশের মেধাবীদের বিদেশে গিয়ে গবেষণা করতে হয়। কারণ এ দেশে তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। এভাবে মেধার পাচার হচ্ছে এটা সকলেই জানি। তারপরেও কেন এ বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া হচ্ছে না—এ প্রশ্ন সবার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সে সুযোগ আরো কম।
উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা বলা হলেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা না বললেই নয়। ১৯২১ পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর এখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিল খুব কমই। এখানেও মৌলিক গবেষণা হয় না। গবেষণা হয় ঠিকই কিন্তু তা শুধু সেমিনারভিত্তিক। বাস্তব গবেষণার হার খুবই কম। নতুন উদ্ভাবন খুবই কম। যা বড়ই হতাশাজনক। যার অন্যতম কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে গবেষণার জন্য বরাদ্দ কম। আর্থিক দুরবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাত। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বছর শুধু গবেষণা খাতেই ব্যয় হয়েছে ৮০০ মিলিয়ন ডলার। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১৫ কোটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যখন এ অবস্থা তখন বাকিগুলোর কী অবস্থা এটা অনুমান করলেই বোঝা যায়।
আমাদের ছাত্রসমাজের কিছু করার নেই। কারণ আমাদের শিক্ষকরাই তো সুযোগ পান না। এভাবেই আমাদের উদ্ভাবনী শক্তি পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে আর পূর্ণতা পায় না। অথচ এই ছাত্রসমাজকে অক্সফোর্ড, হার্ভাডের মতো প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করার সুযোগ দিন, তার ফলাফল যে খারাপ হবে না এটা সুনিশ্চিত। কারণ অতীতের মেধাবীদের সোনালি অর্জন বাংলাদেশ দেখতে পেয়েছে, যাঁরা এ সুযোগগুলো পেয়েছে। শত শত উদহরণ আছে। সব মিলিয়ে আমাদের শিক্ষা খাত পর্যাপ্ত পরিকল্পনার অভাব এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত। আমাদের এ খাতকে এগিয়ে নেওয়ার মতো পরিকল্পনা করা হলেও সেগুলো বাস্তব করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অনেকখানি বাধা।
পরিশেষে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে ব্যয় বাড়ানো উচিত। গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হোক। আমাদের গবেষণার জন্য দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণাকেন্দ্রিক করা হোক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়