বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যার অন্যতম আসামি ‘মুছা বন্ড’ ছাড়াই মামলার রায় হতে চলেছে। অন্য সব আসামি গ্রেফতার বা আদালতে আত্মসমর্পণ করলেও মুছা এখনও অধরা। যদিও তাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভুমিকা হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। বুধবার (১৬ সেপ্টেম্বর) এই মামলায় প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়েছে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান।
একবছর তিন মাস আগে মানুষকে স্তম্ভিত করে দেওয়া ওই হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ যে ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়, তাদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জনের বিচার চলে জজ আদালতে। বাকি ১৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় বরগুনার শিশু আদালতে আলাদাভাবে বিচার চলছে। প্রাপ্ত বয়স্ক ১০ আসামির মধ্যে স্বাক্ষী থেকে আসামি হয়ে যাওয়া নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিও রয়েছেন। আলোচিত এ মামলার ২৩ আসামি গ্রেফতার হয়েছেন বা আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। এর মধ্যে ছয় কিশোর অপরাধী সংশোধনাগারে রয়েছেন। আর মিন্নিসহ নয়জন জামিনে রয়েছেন।
এই ‘মুছা বন্ড’ মামলার এজাহারের প্রধান আসামি ‘নয়ন বন্ডের’ সহযোগী ও বন্ড গ্রুপে ‘মুছা ভাই’ হিসেবে পরিচিত ছিল। ‘নয়ন বন্ড’ পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। ফলে পুলিশের অভিযোগপত্রে তার নাম আসেনি। পুলিশের দেয়া অভিযোগপত্রে মুছা বন্ডকে ৫নং আসামি এবং সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘মুছা বণ্ডের’ বাড়ি বেতাগী উপজেলার সরিষামুড়ি কালিকাবাড়ি এলাকায়। তার বাবা আবুল কালাম ১০-১২ বছর আগে বরগুনা শহরে এসে ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। তিনি করাতকলের শ্রমিক ছিলেন। মা গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। কিশোর বয়সে মুছা প্রথম আলোচনায় আসে ছাগল চুরি করে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে শহরের কলেজ সড়ক এলাকায় একটি ছাগল চুরির পর স্থানীয়রা তার মাথা ন্যাড়া করে জুতোর মালা গলায় দিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করায়। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু কিছু দিন পর আবার বরগুনায় ফিসে আসে সে। এরপর বরগুনা শহরে ছাত্রাবাস থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে এসে ছাত্রদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতো মুছা ও তার বন্ধুরা। ইতোমধ্যে মুছার বড় ভাই আল আমিন ঢাকা থেকে বরগুনায় ফিরে এসে মুছাকে বিদ্যুতের মিস্ত্রির কাজে লাগায়।
এক পর্যায়ে মুছার পরিচয় হয় বন্ড গ্রুপ ০০৭ এর প্রধান ‘নয়ন বন্ডের’ সঙ্গে। তখন থেকে তার নামের শেষে বন্ড উপাধি যুক্ত হয়ে ‘মুছা বন্ড’ নাম হয়। তবে গ্রুপের সদস্যরা ও এলাকার ছেলেরা তাকে ‘মুছা ভাই’ বলে ডাকতো।
রিফাত শরীফ হত্যার পরও মুছার পরিবার শহরের ধানসিঁড়ি এলাকার ভাড়া বাসায় ছিলেন। কিন্তু চার্জশিটে আসামি হওয়ার পর পরিবারের সবাই নিরুদ্দেশ। এলাকায় খোঁজ নিলে কেউ তাদের সন্ধান দিতে পারেনি। মুছার বাবা যে করাতকলে চাকরি করতেন, সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রিফাত হত্যার পর তিনি কাজে অনিয়মিত ছিলেন। ঘটনার মাস দুয়েক পর তিনি আর কাজে আসেননি। শহরের বেশ কয়েকজন ইলেকট্রিশিয়ানের কাছে তার ভাই আল আমিনের সম্পর্কে জানতে চাইলে কেউ সন্ধান দিতে পারেননি।
উজ্জ্বল নামের একজন ইলেকট্রিশিয়ান দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, রিফাত হত্যার পর মাস খানেক আল আমিন বরগুনায় ছিলেন, এরপর তিনি ঢাকা চলে যান। সরিষামুড়ি গ্রামের লোকজন জানান, দীর্ঘ বছর ধরে মুছার পরিবার গ্রামছাড়া। হত্যাকাণ্ডের পর তাদের এলাকায় দেখা যায়নি।
অন্যদিকে গত ৪ সেপ্টেম্বর ‘মুছা বণ্ড’ নামের আইডি থেকে একটি ছবি পোস্ট করা হয়। এতে ক্যাপশনে লেখা, ‘অন্ধকার আমার ভালো লাগে’। এর আগে ২২ আগস্ট কয়েকজনের সঙ্গে তোলা ‘মুছা বন্ডের’ একটি ছবি পোস্ট করা হয়। এছাড়াও ১৭ জুন পোস্ট করা একটি ছবিতে তাকে একটি ফুটওভার ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এতে ক্যাপশন লেখা রয়েছে, ‘এখন আর চিন্তা করি না, বিপদ যে দিয়েছে, সে বিপদ থেকে মুক্ত করে দেবে’।
‘মুছা বন্ড’ নামের এই আইডির বন্ধু তালিকায় থাকা বেশ কয়েকজন আইডিটি ‘মুছা বন্ডের’ বলে নিশ্চিত করে দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ওই আইডিতে তাকে প্রায়ই সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কয়েকজন জানান, ‘মুছা বন্ডের সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে তাদের চ্যাটিংও হয়েছে।’
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বর্তমানে পিরোজপুরের ইন্দুরকানি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইল ফোনে দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, মুছার বিরুদ্ধে ঘটনায় জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে, সেই কারণে তাকে অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে। তাকে গ্রেফতারের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে পুলিশ।
গত বছরের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাত হত্যাকাণ্ড ঘটে। ওই বছর ১ সেপ্টেম্বর ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক দুইভাগে বিভক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জন এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার চার্জশিটভভুক্ত প্রাপ্তবয়স্ক আসামি মো. মুসা এখনও পলাতক রয়েছেন।