বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যার ভিডিও চিত্র দেখে হৃদয় কাঁপেনি—এমন কোনো ব্যক্তি নেই। ২৬ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে প্রকাশ্য দিবালোকে কলেজের সামনের ব্যস্ত সড়কে এ নির্মম ও লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে। রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে স্বামীকে বাঁচানোর জন্য পাগলের মতো হত্যাকারীদের নিবৃত্ত করতে আমরা দেখেছি।
তিনি অসহায়ের মতো চিৎকার করছিলেন এবং স্বামীকে বাঁচানোর জন্য কাকুতি করছিললেন। তাঁর এ প্রচেষ্টার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা বা অভিনয় ছিল—তেমন কোনো কিছু দর্শকের মনে হয়নি। সোমবার (২২ জুলাই) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন এ কে এম শহীদুল হক।
ঘটনার ২৬ দিন পর অর্থাৎ ১৭ জুলাই পুলিশ মিন্নিকে দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের দাবি, মিন্নি হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং তিনি পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
মিন্নিকে আদালতে হাজির করে পুলিশ রিমান্ড প্রার্থনা করলে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সবচেয়ে আশ্চর্য ও দুঃখজনক বিষয় হলো, আদালতে মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়াননি। আদালতে উপস্থিত আইনজীবীদের কেউ মিন্নির পক্ষে বক্তব্য দেবেন কি না জানতে চেয়েও বিচারক কোনো আইনজীবীর সাড়া পাননি। মিন্নি আদালতে নিজ আরজিতে স্বামী হত্যার বিচার চেয়েছিলেন।
মিন্নির পক্ষে আইনজীবী থাকবে না—এটি স্বাভাবিকভাবে সমর্থন করা যায় না। অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনে আইনি সহায়তা পাওয়া তাঁর সাংবিধানিক অধিকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার আসামিদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন। যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামিদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন। ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের আসামিদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও জঙ্গি যারা মামলার আসামি ছিল, তাদের সবার পক্ষেই আইনজীবী ছিলেন।
মিন্নি তো কোনো দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বা জঙ্গি নন। তিনি সাধারণ পরিবারের একজন সাধারণ নারী। তাঁর পক্ষে কেন আইনজীবী থাকবেন না। কোনো কোনো সংবাদ প্রতিবেদনে জানা যায়, একটি মহল কর্তৃক আইনজীবীদের সতর্ক করা হয়েছিল, যাতে কেউ মিন্নির পক্ষে অবস্থান না নেন। এটি সত্য হলে অভিযোগটি গুরুতর। একজন নাগরিকের আইনের সহায়তা নেওয়ার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার শামিল।
রিফাত হত্যার অভিযুক্ত আসামিরা সন্ত্রাসী প্রকৃতির ও তারা মাদক কারবারসহ নানা রকম অপরাধে জড়িত ছিল বলে স্থানীয় জনগণের কেউ কেউ বিভিন্ন মিডিয়ায় অভিযোগ করেছে। নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীর নেতৃত্বে ০০৭ বন্ড নামে কিশোর অপরাধ চক্র গড়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রভাবশালী ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক নেতৃতের ছত্রচ্ছায়ায় ছিল।
কেউ কেউ তাদের আত্মীয়ও বটে। প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় প্রশাসন ও পুলিশ তাদের অনেকের অপকর্মের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় ছিল বলে অভিযোগও আছে। কিন্তু নয়ন বন্ডকে পুলিশ একাধিকবার গ্রেপ্তার করেছে। তার বিরুদ্ধে পাঁচ থেকে সাতটি মামলাও আছে। অন্যদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। কিন্তু তারা বেপরোয়া প্রকৃতির ছিল। তাদের এলাকার শান্তিপ্রিয় লোকজন ভয় পেত।
হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্ত আসামিরা যেসব প্রভাবশালী মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছত্রচ্ছায়ায় থেকে অপরাধজগতে সক্রিয় ছিল, সেসব প্রভাবশালী মহল রিফাত শরীফের নৃশংস ও মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিদের বিপক্ষে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিল না।
অভিযোগ আছে, একজন সাবেক সংসদ সদস্যের পুত্রের ছত্রচ্ছায়ায় নয়ন বন্ড বেপরোয়া হয়ে ওঠে। রিফাত হত্যার পর তিনি মিন্নির চরিত্র হনন করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। হত্যাকারীদের বিচার চাওয়ার পরিবর্তে তিনি মিন্নিকে গ্রেপ্তার করার জন্য মানববন্ধন করেন। এতে সচেতন মহলের ধারণা সৃষ্টি না হওয়ার কারণ নেই যে একটি শক্তিশালী মহল খুনিদের পক্ষে নেপথ্যে ও কৌশলে অবস্থান নিচ্ছে এবং পুলিশকে প্রভাবিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
মিন্নি এক সাধারণ পরিবারের মেয়ে। তিনি কোনো প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদে নেই। তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তে সাক্ষ্য-প্রমাণ পেলে পুলিশ এমনিতেই আইনগত ব্যবস্থা নেবে। এ জন্য মানববন্ধন ও সামাজিক মিডিয়ায় চরিত্র হনন করার প্রয়োজন আছে কি?
পুলিশ সুপার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, মিন্নি হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। কী অবস্থায় কতটুকু সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন, তা পুলিশই বলতে পারবে। তিনি আরো বলেছেন, আসামিদের সঙ্গে মিন্নির কথোপকথনের প্রমাণ আছে। হয়তো এসব তথ্য ঠিক। কিন্তু প্রমাণের ঊর্ধ্বে নয়। মিন্নির বক্তব্য ও অন্য আসামিদের স্বীকারোক্তি, কথোপকথনের সব কিছুই তদন্তের মাধ্যমে সত্যতা প্রমাণ করতে হবে।
আসামিরা আদালতে যে স্বীকারোক্তি দিয়েছে, তার সত্যতা প্রমাণ করতে হবে। অতীতে এমন অনেক ঘটনায় দেখা গেছে, আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তি দেওয়ার সময় তাদের প্রতিপক্ষ বা বাদী-সাক্ষীদের কাউকে জড়িত করে নিজেরা ফায়দা নিয়ে বিপক্ষকে ফাঁসাতে চায়। তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্তে আসামির ওই স্বীকারোক্তি সমর্থনযোগ্য সাক্ষ্য (Corroborotive Evidence) দ্বারা প্রমাণ করতে হবে।
মিন্নি ও অভিযুক্ত আসামিরা একই এলাকার বাসিন্দা ও একে অপরের সঙ্গে পরিচিত। তাই তাদের মধ্যে কথোপকথন হতেই পারে। পুলিশ হয়তো সিডি আর বিশ্লেষণ করে কললিস্টে নয়ন বন্ড কিংবা অন্য কোনো আসামির সঙ্গে মিন্নির কথোপকথনের প্রমাণ পেয়েছে। কিন্তু কী কথা হয়েছিল, তা জানা প্রয়োজন। অডিও থাকলে সেগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। সব বিষয় তদন্ত করে দেখতে হবে। প্রভাবশালী মহলের তৎপরতায় প্রাপ্ত প্রাথমিক তথ্য যাচাই-বাছাই না করে কারো বিরুদ্ধে তা ব্যবহার করা সমীচীন হবে না।
সর্বশেষ জানা যায়, মিন্নি ১৯ জুলাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে কী বলেছেন, তা এখনো জানা যায়নি। একই কথা পুনরাবৃত্তি করতে হয়, তা হলো স্বীকারোক্তি বিশ্লেষণ করতে হবে। বক্তব্যের বিষয় তদন্ত করতে হবে। স্বামী হত্যার পর মিন্নি যে প্রচণ্ড মানসিক ও সামাজিক চাপের মধ্যে ছিলেন, ওই অবস্থা ও পারিপার্শ্বিকতাকে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।
এটি নিশ্চিত যে নয়নের সঙ্গে মিন্নির একটা সম্পর্ক ছিল। বিয়ের কথা মিন্নি অস্বীকার করলেও কাজির কথায় বিয়ের বিষয়টির প্রাথমিক সত্যতা প্রতীয়মান হলেও কী পরিবেশে বিয়েটি হয়েছিল এবং মিন্নি বিয়ে মেনে নিয়েছিল কি না, মিন্নির পরিবার এ বিয়ে সম্পর্কে অবগত আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখতে হবে। আর নয়নের সঙ্গে বিয়ে হয়ে থাকলে কয়েক মাস পর আনুষ্ঠানিকভাবে যখন মিন্নির রিফাত শরীফের সঙ্গে বিয়ে হয় তখন নয়ন বন্ড কী ভূমিকা পালন করেছিল।
একই কাজির বিয়ে রেজিস্ট্রি করার কথা। এ ক্ষেত্রে কাজির ভূমিকা কী ছিল ইত্যাদি বিষয় তলিয়ে দেখা আবশ্যক। মিন্নি একই সঙ্গে দুটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য মিন্নি দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। সে বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু হত্যাকাণ্ড ভিন্ন বিষয়। তাঁর স্বামী রিফাত শরীফকে হত্যা করে মিন্নির কী লাভ! হত্যার মোটিভ কী, সেটিও তদন্তের দাবি রাখে। তাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মিন্নির সম্পৃক্ততার বিষয়টি সতর্কতা ও সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে গভীরভাবে দেখতে হবে। পুরো ঘটনার মধ্যে মিন্নি যতটুকু জড়িত তাঁর দায় ততটুকুই। ন্যায়বিচারের স্বার্থে এ বিষয়ের ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে।
আদালতে মামলা পরিচালনা করা একটি জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ বিষয়। মিন্নি বা তাঁর বাবার পক্ষে মামলা পরিচালনা করা কঠিন হবে। শুরুতেই আইনজীবীরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন, যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। প্রভাবশালীদের ভয়ে যদি আইনজীবীরা তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে না চান এবং একজন নাগরিককে তার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে তা হবে একটি গণতান্ত্রিক সমাজে কলঙ্কজনক ঘটনা।
যার তদবিরকারী নেই, যার পক্ষে প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদ নেই তার একমাত্র ভরসা আইন-আদালত। আমার বিশ্বাস, মিন্নি সে জায়গায় ন্যায়বিচার পাবেন। পুলিশকে শতভাগ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে সাহসের সঙ্গে তদন্ত করতে হবে। দুর্বলের পাশে আইনগত অবস্থান নিয়ে পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আইনজীবীদের মিন্নির পক্ষে আইনি সহায়তা দিতে এগিয়ে আসতে হবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র, নারী সংগঠন এবং লিগ্যাল এইডের সহায়তাও মিন্নি নিতে পারেন।
রিফাত হত্যার সঠিক বিচার হোক। প্রকৃত খুনিরা যাতে ছাড় না পায় এবং নির্দোষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সেটিই দেশবাসী ও সচেতন নাগরিকের কাম্য।
লেখক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল
বাংলাদেশ পুলিশ