রিফাত হত্যার নেপথ্যে মাদক!

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বরগুনায় রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার পর নেপথ্যে মাদকের বিষয়টি উঠে আসে। নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির ব্যানারে মানববন্ধনে এমনটাই দাবি করা হয়েছিল। মাদক নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে রিফাতকে খুন করা হয়েছে এমন তথ্য বিভিন্ন সূত্রেও জানা গেছে। ওই সূত্রগুলো বলছে, এর আগেও মাদক নিয়ে রিফাত শরীফের সঙ্গে সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ডের বিরোধ ছিল। সেই বিরোধের জের ধরেই রিফাতকে মাদক দিয়ে নয়ন ফাঁসিয়েছিল। মাদক সম্পৃক্ততার দায়ে রিফাত জেলেও ছিল। পুরো ঘটনা সবার জানা। তবু জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন অভিযোগপত্র দেওয়ার আগেই সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন, রিফাত খুনের সঙ্গে মাদকের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তবে তিনি বলেছেন, আসামিদের অনেকেই মাদকসেবী ও কারবারি। শুক্রবার (১৯ জুলাই) কালের কণ্ঠ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রফিকুল ইসলাম।

পুলিশ সুপার মারুফ হোসেনের এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বরগুনার আইনজীবী মুজিবুল হক কিসলু বলেন, ‘যেহেতু এটি একটি স্পর্শকাতর মামলা। মামলাটি তদন্তাধীন, তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। এ ছাড়া আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হলে তাকে আদালতে হাজির করে বিচারকের সামনে স্বীকারোক্তি নেবেন। সে ক্ষেত্রে আগাম কোনো সিদ্ধান্ত দেয়া বিধিসম্মত নয় বলেই আমি মনে করি।’

স্থানীয় লোকজন বলছে, বরগুনা শহরে কান পাতলেই শোনা যাবে, রিফাত হত্যার আসামিরা মাদক ও মোটরসাইকেল চোরাচালানের সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। প্রধান আসামি, যে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে সেই নয়ন বন্ড ১০০ জনের বেশি সদস্য নিয়ে ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপ ‘০০৭’-এর মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতো। নয়নেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রিফাত শরীফ। নয়নের গ্রুপ থেকে বের হয়ে এসে মনজুরুল আলম জনের গ্রুপে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এর কয়েক মাস পর গত ২৬ জুন বন্ড গ্রুপের সন্ত্রাসীরা নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে রিফাতকে।

রিফাত হত্যার ঘটনায় তাঁর বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফের দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি নয়ন গত ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পরপরই জন তাঁর সেই নেটওয়ার্কের কর্তৃত্ব নিয়ে নেন।

নয়নের মা শাহিদা বেগম সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁর ছেলে বরগুনা কলেজে পড়ে। কিন্তু শিক্ষকদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম প্রচার করেছে যে সে বহিরাগত।

শাহিদা বেগম আরও বলেন, গত বছর বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় নয়ন ‘দাদা’র সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু কে সেই ‘দাদা’ তা শাহিদা বেগম পরিষ্কার করে বলেননি।

তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, ওই নির্বাচনের সময় যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ায় ‘দাদা’র সঙ্গে নয়নের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। দাদা অর্থাৎ সুনাম দেবনাথের গ্রুপ ছাড়ার ব্যাপারে নয়নের সিদ্ধান্ত ভালোভাবে নিতে পারেননি নিহত রিফাত শরীফ। রিফাত সুনাম দেবনাথ সমর্থিত জনের সঙ্গেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ কারণে দুই বন্ধু পরিণত হয় শত্রুতে।

জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জুবায়ের আদনান বলেন, ‘সুনামের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদে নয়ন মাদক চোরাকারবার ও মোটরসাইকেল চোরাচালানে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। মাদক চোরাকারবার, চোরাচালান ও আরো ক্ষমতা লাভের আশায় সুনাম সেই গ্যাং গঠন করেন।’ এর আগেও সংবাদ সম্মেলনে করে সুনামের বিরুদ্ধে মাদকের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলেছিলেন জুবায়ের।

সুনাম দেবনাথ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিলেন, তাঁর বাবা ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু যাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পান সে জন্য আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তাঁর বাবার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে তাঁর বিরুদ্ধে মাদকের মিথ্যা অভিযোগ তুলেছিল ওই পক্ষ। 

রিফাত হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর গত ২৮ জুন সকালের দিকে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির কথা হয়। তিনি বলেন, রিফাতের সঙ্গে নয়নের বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক ছিল। হঠাৎ করেই নয়নের বাসায় মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযান চালায়। রিফাতের দেয়া তথ্য মতে সেই অভিযান পরিচালিত হয়েছে বলে নয়ন দাবি করে। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত। সেই ঘটনার জের ধরে রিফাতকে ১৫ গ্রাম গাঁজা দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেয় নয়ন। রিফাত মাদকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তিনিও এ ব্যাপারে নয়নের সঙ্গে বাগিবতণ্ডায় লিপ্ত হয়েছিলেন।

একই দিন (২৮ জুন) রিফাতের বাসায় গিয়ে তাঁর বাবা দুলাল শরীফের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেছেন, নয়ন পরিকল্পিতভাবে গাঁজা দিয়ে তাঁর ছেলে রিফাতকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। রিফাত ১৬ দিন জেল খেটে বেরিয়ে আসেন। রিফাতের বন্ধু বরগুনা পৌরসভার প্যানেল মেয়র রইসুল আলম রিপনের ছেলে জন ওকে ছাড়িয়ে আনেন। এ নিয়ে রিফাতের স্ত্রী নয়ন বন্ডকে গালাগাল করেছিলেন। রিফাতের মাধ্যমে পরে তাঁরা ঘটনাটি জেনেছিলেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘রিফাত মাদকসেবীদের সহ্য করতে পারত না। শুনেছি নয়ন বন্ডের সঙ্গে এ নিয়ে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে।’

বরগুনার সাংবাদিক রুদ্র রুহান বলেন, “চলতি বছরের ১৬ মার্চ রিফাত শরীফকে ১৫ গ্রাম গাঁজাসহ পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। ওই রাতেই নয়ন বন্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে ভিডিও ফুটেজ আমাকে পাঠায়। পরের দিন নয়নের সঙ্গে আমার কথা হয়। তখন নয়ন বলে, পুলিশ দিয়ে রিফাত আমাকে হয়রানি করছে। রিফাতের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বেশ কয়েকবার পুলিশ আমার বাসায় অভিযান চালিয়েছিল, কিন্তু কোনো মাদক পায়নি। রিফাতকে মাদকসহ গ্রেফতারের ব্যাপারে তার (নয়ন) সম্পৃক্ততার (পুলিশকে জানানো) বিষয়টিও আমার কাছে স্বীকার করে বলে, ‘ভাই, আমি ভালো হয়ে গেছি। এখন আর মাদকের সঙ্গে আমি জড়িত নই।”’    

রিফাত হত্যাকাণ্ডের পেছনে মাদকের বিষয়টি জড়িত দাবি করে গত ১৪ জুলাই বরগুনা প্রেস ক্লাবের সামনে বরগুনা জেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির ব্যানারে মানববন্ধন হয়। মানববন্ধন কর্মসূচিতে এমপিপুত্র সুনাম অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি মাদক নিয়ে কোনো বক্তব্য দেননি।

এর আগের দিন শনিবার রিফাতের বাব দুলাল শরীফ সংবাদ সম্মেলন করে মিন্নির গ্রেফতার দাবি করেন। এর পরদিন একই দাবিতে ‘বরগুনার সর্বস্তরের জনগণ’ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। এর পরই রিফাত হত্যা মামলার তদন্ত নাটকীয় মোড় নেয়। মঙ্গলবার জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে মিন্নিকে পুলিশ লাইনসে নিয়ে যাওয়া হয় এবং প্রায় ১২ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁকে গ্রেফতার দেখানো হয়।

জেলা ছাত্রলীগের উদ্যোগে গত বছর সংবাদ সম্মেলন করে মাদকের গডফাদার হিসেবে এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ওই সংবাদ সম্মেলনে নয়ন বন্ডের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা হিসেবে সুনামের নাম বলা হয়েছিল।

বরগুনা জেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন কামাল বলেন, রিফাত শরীফকে যারা কুপিয়ে হত্যা করেছে তারা প্রায় প্রত্যেকেই মাদকাসক্ত। তাদের মধ্যে ঘটনার মূল হোতা নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী উভয়েই মাদক কারবারি। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে নয়ন ও তার দুই সহযোগীকে বিপুল পরিমাণ মাদকসহ গ্রেফতার করা হয়েছিল। নয়ন ও রিফাত ফরাজীর বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় একাধিক মামলাও রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এরা চিহ্নিত মাদক কারবারি, যে কারণে তুচ্ছ বিষয় নিয়েই রিফাত হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে বলে আমরা মনে করি।’

তবে রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে মাদকের কোনো সম্পৃক্ততা নেই, ব্যক্তিগত কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার এ কথা বলেন। রিফাত শরীফ হত্যা মামলার ৩ নম্বর আসামি রিশান ফরাজীকে গ্রেফতারের বিষয়ে এ সংবাদ সম্মেলন ডাকে বরগুনা জেলা পুলিশ।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেন, ‘এটা একটি খুনের ঘটনা, আমরা এ ঘটনায় এমন কোনো বিষয় জড়াতে চাই না যাতে হত্যার বিষয়টি চাপা পড়ে।’

এর আগে গত মঙ্গলবার রাত ৯টায় মামলার প্রধান সাক্ষী নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এরপর সংবাদ সম্মেলন ডেকে পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বক্তব্য দেন। সেখানেও তিনি একই কথা বলেন। তিনি বলেন, অনেকে বলেছেন রিফাত হত্যার ঘটনায় মাদকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, আসলে ব্যক্তিগত কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। এতে মাদকের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037519931793213