শিক্ষানগরী খ্যাত রাজশাহীর অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট)। কয়েক মাস ধরেই নানা বিশৃঙ্খলা চলছে। এর মধ্যে গত ১০ মে থেকে ৪৩ দিনের লম্বা ছুটি শুরু হয়েছে। ছুটির পর আবারও রুয়েট অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কী কারণে এমন বিশৃঙ্খলা? এর নেপথ্য কারণ হিসেবে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনাকে চিহ্নিত করেছে অনেকে। সর্বশেষ ছুটির দুই দিন আগেও রাতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়াধায়ির ঘটনা ঘটেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রুয়েটে প্রায় তিন বছর ধরে উপ-উপাচার্যের পদটি শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া কয়েক বছর ধরে আওয়ামীপন্থী শিক্ষক পরিচয় দিয়ে রুয়েটে উপাচার্য হিসেবে যোগ দিলেও তাঁদের অতীত কর্মকাণ্ডগুলো ছিল বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের সঙ্গে। ফলে আওয়ামীমনা শিক্ষক ও ছাত্রলীগের সঙ্গে বনিবনা হয়ে ওঠেনি উপচার্যের। এ কারণে রুয়েটে কার্যত শৃঙ্খলাও ফিরে আসেনি। বরং দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে বিশৃঙ্খলা।
রুয়েট সূত্র মতে, চলতি বছর একের পর এক অঘটনের জন্ম হচ্ছে রুয়েটে। এর আগে ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর রুয়েট ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ২০১৩ সালে রুয়েট ছাত্র কল্যাণ দপ্তরে পদত্যাগকারী পরিচালকের বিরুদ্ধে তালা ঝোলানো ও ভয়ভীতি প্রদানের অভিযোগ ওঠে। পদত্যাগী ছাত্র কল্যাণ পরিচালক শামীমুর রহমান দপ্তরে এসে পিয়নকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে তালা ঝুলিয়ে দেন। এ ঘটনার মাসখানেক পরই রুয়েট ছাত্রলীগের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের মাধ্যমে ভিসি সিরাজুল করিম চৌধুরীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। ২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে অব্যাহত আন্দোলনের মুখে ভিসি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর আগে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. সিরাজুল করিম চৌধুরী।
সূত্র মতে, ২০০৩ সালের জুন মাসে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপিপন্থী শিক্ষক নেতা অধ্যাপক ড. মো. শামীম আখতার ও ড. এস এম আব্দুর রাজ্জাক, ড. মো. শফিউদ্দিন মিয়াকে নিয়ে জামায়াত-বিএনপি প্যানেলে ভোট করে ছিলেন সিরাজুল করিম চৌধুরী। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে সিরাজুল করিম চৌধুরীর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন করে আওয়ামীপন্থী শিক্ষক প্যানেলে যোগ দেন। এরপর তিনি ২০০৯ সালে ভিসি হন। তাঁর সময়কালেই ১০১২ সালের ১২ মার্চ ছাত্রলীগ নেতা আজিজ হত্যার শিকার হন। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে এ ঘটনা ঘটে। সিরাজুল করিম চৌধুরীর সময়কালে রাজশাহী জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বলকে কোটি কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয় রুয়েটে।
অন্যদিকে রুয়েটের সেলিম হলে প্রায় ১০ লাখ টাকার হাঁড়িপাতিল চুরির অভিযোগ উঠলে জড়িত একজন শিক্ষকসহ অন্যদের বিরুদ্ধে আজও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
রুয়েট সূত্র আরো জানায়, ভারপ্রাপ্ত ভিসি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে অধ্যাপক ড. মর্ত্তুজা আলী নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। পাশাপাশি রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আহসান হাবিবকে রুয়েটের প্রকৌশল শাখায় সহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ দেন তিনি। এতে বঞ্চিত হন রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রলীগ নেতা মো. মোতাহার হোসেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারপ্রাপ্ত ভিসি মর্ত্তুজার আমলে চারটি ডাটা প্রসেসর পদে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে ১০ জনকে একই পদে নিয়োগ প্রদান করেন এবং অন্যান্য পদেও একটি পদের বিপরীতে একের অধিক নিয়োগ প্রদান করে বিতর্কিত হন।
নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ইউজিসি থেকে তৎকালীন সদস্য অধ্যাপক শিবলীকে প্রধান করে ভিসি মর্ত্তুজা আলীর বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভারপ্রাপ্ত ভিসির পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে ২০১৪ সালের ২৮ মে ভিসি হিসেবে অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বেগকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৭ সালের শেষ দিকে বর্তমান ভিসি রফিকুল আলম বেগ রাজশাহী জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি ও শিক্ষক শফিউল আলম লেলিন হত্যা মামলার আসামি আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বলকে আর্কিটেক্ট ভবনের দুই কোটি ৫০ লাখ টাকার একটি কাজ পাইয়ে দেন অনিয়মের মাধ্যমে। পাশাপাশি গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকস ভবনের কাজ নিম্নমানের হলেও পরে আরো ৮০ লাখ টাকা বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে টেন্ডার ছাড়াই প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩০টি এলইডি টিভি কেনেন এই ভিসি।
এর বাইরেও বর্তমান ভিসি যোগদানের পর থেকে ক্যাম্পাসে একের পর এক চুরি, ছিনতাই, মারধর এমনকি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এর মধ্যে গত ২৩ জানুয়ারি ২০১৮ গভীর রাতে রুয়েটের হামিদ হলে ছাত্রলীগের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে ৮ মার্চ রাতে একই হলে আবারও ছাত্রলীগের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। গত ২৩ এপ্রিল রাতে গাড়িচালক আব্দুস সালাম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকস বিভাগে কর্মরত জামায়াত নেতা জাহাঙ্গীর আলমের ভাই সিকিউরিটি গার্ড সোহেল রানাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
জানতে চাইলে রুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি নিড়ি আহমেদ বলেন, ‘কিছু নেতাকর্মী কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রুয়েটকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এ কারণেই একের পর এক ঘটনা ঘটছে।’ একই অভিযোগ করেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমানও।
এসব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রুয়েটের কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক নেতা ও বর্তামন সহকারী কন্ট্রোলার সেডু সরকার বলেন, ‘রুয়েটে বিগত কয়েকজন ভিসি স্বাধীনতার পক্ষের লোক পরিচয় দিয়ে ভিসি হয়ে এলেও তাঁরা আর তাঁদের জায়গায় শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি। তাঁদের অতীত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাঁরা পুনরায় জড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পাসটাকে বিএনপি-জামায়াতের দোসরদের কাছে বিকিয়ে দিয়েছেন। ফলে রুয়েটে বঞ্চিত হয়েছে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিগুলো। এ কারণেই রুয়েটে একের পর এক বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে।’
রুয়েটের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রুয়েটের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনাগুলোই ছাত্রসংগঠনের ওপর গিয়ে প্রভাব ফেলছে। কে ক্ষমতায় থাকবেন, আর কে আসবেন—তা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রদের কাছে গিয়ে ধরনা দিচ্ছেন একেকজন। ফলে একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে রুয়েটে।’
জানতে চাইলে রুয়েটের শিক্ষক সমিতির একজন প্রভাবশালী নেতা বলেন, ‘রুয়েটে চলছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এ নিয়ে একেকজন নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লেও কেউ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আবার বর্তমান ভিসির মেয়াদের শেষ দিকে এসে তিনিও নিজেকে আর সামলে নিতে পারছেন না। ফলে রুয়েটে অস্থিতিশীলতা থাকছেই।’
তবে ভিসি রফিকুল আলম বেগ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘রুয়েটে কিছু ঘটনা ঘটেছে, তা ছাত্রলীগের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে। এখানে প্রশাসনের কারণে কিছু ঘটেনি। আবার খুনের ঘটনাটি ঘটেছে ব্যক্তিগত স্বার্থের জের ধরে। ফলে এখানে আমাদের কিছুই করার নেই।’