র‌্যাগিংয়ের ভয়াবহতা এবং উচ্চশিক্ষার অন্তরায়

ড. সুলতান মাহমুদ রানা |

যেকোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নবাগত শিক্ষার্থীদের কাছে ‘র‌্যাগিং’ শব্দটি আতঙ্কের। ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা, ভর্তি হওয়া, নতুন ক্লাস শুরু করা—সব কিছুর মধ্যেই ‘র‌্যাগিং’ নামের একটি আতঙ্ক বিরাজ করে। দীর্ঘদিন থেকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘র‌্যাগিং’ নামের একধরনের সহিংসতা নীরবে-নিভৃতেই চলে আসছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের নামে চলে নবাগত শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন। এ বছরের শুরুতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেশ কিছু র‌্যাগিংয়ের খবর আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। গত ২১ জানুয়ারি থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। এর পর থেকে প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কয়েকটি রাবির র‌্যাগিংয়ের খবর প্রকাশ হয়েছে। বিশেষ করে ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে ক্যাম্পাস ছাড়ার খবরটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। আর এই র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠেছে ওই বিভাগেরই সিনিয়র কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। প্রথম বর্ষের ওই শিক্ষার্থী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, র‌্যাগের প্রভাব যেন আর কোনো মা-বাবার ওপর না পড়ে। আমি নিজের মর্যাদাহানি করতে পারব, কিন্তু আমার মা-বাবাকে অপমানিত হতে দেব না।…বিদায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।’ ওই শিক্ষার্থী যদি সত্যিই বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ফিরে না আসে, তাহলে এ খবরটি যে কতটা দুঃখজনক তা ভাবতেই কষ্ট হয়।

এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে হাজার হাজার জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর প্রত্যেকেই যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় না, সেখানে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরও যদি তা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখ আর কিছু থাকতে পারে না। দেশের মোট উচ্চশিক্ষার্থীর একটি ক্ষুদ্র অংশ (৫ শতাংশ) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সত্যি বলতে তাঁরাই দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার; যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অধিকার আদায় করেছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যেও কেউ যদি র‌্যাগিংয়ের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমেই ছিটকে পড়ে, তাহলে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

পুরনো শিক্ষার্থী কর্তৃক নবীন শিক্ষার্থী নিপীড়ন, নিগ্রহের শিকার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলে এর দায় থেকে আমরা কেউই মুক্ত হতে পারি না। একজন নবাগত শিক্ষার্থীর পড়ালেখার পরিবেশ সৃষ্টি ও তার নিরাপত্তার দায় আমাদের সবার। একজন শিক্ষার্থী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখে, তখন তার শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্বটি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও কোনোভাবেই মুক্ত নয়।

আগে একসময় ছিল যখন হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমন নির্মম র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ পাওয়া যেত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং ছিল খুবই নগণ্য মাত্রায়। তবে অন্য কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এই র‌্যাগিংয়ের পরিমাণটি ছিল অতিমাত্রায়। কিন্তু এ বছর র‌্যাগিং প্রভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা রীতিমতো আতঙ্কে রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন নবাগত শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপ করে জানতে পেরেছি যে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর থেকে প্রতিটি ক্ষণ আতঙ্কে রয়েছে। তাদের মনে একটিই প্রশ্ন—কখন এই র‌্যাগিং আতঙ্ক থেকে তারা মুক্ত হবে! একজন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসার পর থাকা-খাওয়ার অনেক অসুবিধায় পড়তে হয়। প্রথম থেকেই তারা একটি বিপত্সংকুল অবস্থার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করে। এর পরে যদি ‘র‌্যাগিং’ আতঙ্কটি তাদের পেছনে লেগে থাকে, তাহলে ওই শিক্ষার্থীকে প্রতিটি ক্ষণ কতটা ভয়াবহভাবে অতিবাহিত করতে হয়, তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি।

রাবি একটি অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে নবাগত শিক্ষার্থীদের হলে থাকার ব্যবস্থা করা হয় না। ফলে তারা বিভিন্নভাবে আবাসিক সংকটের মুখোমুখি হয়। অন্যদিকে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক, সেগুলোতেও নবাগতদের যথাযথভাবে থাকার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে বাংলাদেশের একমাত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলতে পারি। সেখানে গত সেপ্টেম্বর মাসে আমি নিজে Institution of Quality Assurance Cell (IQAC)-এর একজন বিষয়-বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিন দিন ধরে একটি কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে দেখতে পেয়েছি যে আবাসিক হলে একটি চার আসনবিশিষ্ট কক্ষে ২০-২৫ জন নবাগত শিক্ষার্থীকে ফ্লোরিং করে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এ অবস্থায় তারা এমনিতেই একটি সমস্যাসংকুল পরিবেশে অবস্থান করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় র‌্যাগিংয়ের ভয়াবহতা।

প্রায়ই শোনা যায়, র‌্যাগিং ইস্যুতে সিনিয়র ছাত্রদের মধ্যেই পাল্টাপাল্টি দ্বন্দ্বের খবর। সাধারণত দেখা যায়, সিনিয়র ছাত্ররা র‌্যাগিংয়ের মাধ্যমে জুনিয়রদের অনুগত ও বাধ্যগত করতে চেষ্টা করে। অনেক সময়ই জুনিয়রদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে। র‌্যাগিংয়ের এই নির্যাতন বন্ধে কোনো প্রশাসন কিংবা কোনো কর্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত বিশেষ কোনো প্রতিরোধ কিংবা প্রতিকারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পেরেছে কি না সেটি আমার জানা নেই। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে মনে হয় যে সরকারদলীয় ছাত্ররাজনীতির দাপটে প্রশাসন কিংবা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়। আর এ কারণে চলে নীরব নিপীড়ন, নির্যাতন।

বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নানা রকম নির্মম র‌্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কোনোটিরই ন্যায্য প্রতিবাদ কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ঘটনা ঘটেনি। যারা র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করছে, তারাই আবার পরবর্তী সময় র‌্যাগিং ঘটনার নায়কে পরিণত হচ্ছে। বেশির ভাগ ছাত্রই র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে না। কারণ তারা মনে করে, প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবে না। বিশেষ করে নবাগত শিক্ষার্থী যারা নিতান্তই অসহায়, যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কাছের কোনো বড় ভাই-বোন নেই, তারাই র‌্যাগিংয়ের শিকার হয় অতিমাত্রায়। ফলে তারা অভিযোগ দিতে সাহস পায় না।

র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থী স্বপ্নসিঁড়িতে পা রাখতেই হোঁচট খায়। অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করে, আত্মহত্যার চেষ্টা করে ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অভিযুক্তদের প্রতি কর্তৃপক্ষের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না থাকার কারণে অবিরাম চলছে এমন নির্মমতা ও নির্যাতন। র‌্যাগিংয়ের অত্যাচারে একজন শিক্ষার্থীর যে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়। কাজেই শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে র‌্যাগিংমুক্ত পরিবেশ আবশ্যক। আর এ জন্য প্রতিটি র‌্যাগিংয়ের ঘটনাকে আমলে নিয়ে সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে ভবিষ্যতে এটি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করার আশঙ্কা থেকেই যাবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0048887729644775