বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানচর্চা বলতে যা বোঝায় তা দিন দিন দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। কেননা বর্তমানে যেটুকু জ্ঞানচর্চা হচ্ছে তার অধিকাংশই ভালো রেজাল্ট, পজিশন ও চাকরি পাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যার ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকে ইনটেলেকচুয়াল ব্যক্তিত্ব তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো জনবল তেমন একটা তৈরি হচ্ছে না।
অথচ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এই বুদ্ধিবৃক্তিক জ্ঞান খুবই প্রয়োজন, যা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের শূন্যতা পূরণ করবে। এখন প্রশ্ন হলো—কেন এমন হচ্ছে? উত্তরে আমরা বলতে পারি—প্রথমত, আমাদের পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থা এর জন্য দায়ী। কেননা পড়াশোনাকে পুঁজি করে আমরা টাকা-পয়সার পাহাড় গড়তে চাই। দ্বিতীয়ত, পড়াশোনার উদ্দেশ্য যে জ্ঞানার্জন করা সেই শুভবোধের বিলুপ্তি সাধন হয়ে চাকরি অর্জনটাই আমাদের পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তৃতীয়ত, যে এক-দেড় শ বছর আগেকার ব্রিটিশ আইন এদেশে তৈরি হয়েছে রাষ্ট্র সেভাবেই চলছে। সেকালের শিক্ষা ও চাকরি কাঠামোকে কোনো সংস্কার না করে একালেও গতানুগতিক ধারায় বহমান রেখেছে। চতুর্থত, গবেষকদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো চাকরির ব্যবস্থা নেই বলে কেউ গবেষণার দিকে ধাবিত হচ্ছে না। পঞ্চমত, রেজাল্টভিত্তিক কোনো চাকরির ব্যবস্থা দেশে নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রথম বর্ষ থেকেই সবাই বিসিএস সিরিজের বই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। অথচ সে তার একাডেমিক সিলেবাসটাও পর্যন্ত খুলে দেখে না।
এছাড়া এখানকার মানসিকতায়, এমনকি বাস্তবতাতেও দেখা যাচ্ছে—বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের পজিশনধারীদেরই বেশিদিন বেকার থাকতে হয়। বিশেষ করে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে। অন্যদের মধ্যে যারা সারা বছর বিসিএস পড়ে, তারাই তুলনামূলক ভালো চাকরি পাওয়ার পাশাপাশি প্রশাসনকে পরিচালনা করছে। আজকের শিক্ষার্থী ও তরুণ প্রজন্ম যে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানার্জন ও গবেষণা থেকে পিছিয়ে পড়ছে, এর জন্য দায়টা কার। আপনার, আমার নাকি অর্থনৈতিক জর্জরতার। এর পুরো দায়টা রাষ্ট্র ও তার চাকরি ও শিক্ষা কাঠামোর ওপর বর্তায়।
আপনার আর আমার মতো শিক্ষার্থীরা পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে বিসিএসের কোচিং আর এমপি থ্রি, ওরাকলের মধ্যে জ্ঞানচর্চাকে সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে। যারা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানার্জন করে থাকে তাদেরও এর ভোগান্তি পেতে হয়। যে ভোগান্তির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে সৃজনশীল ও মেধাবী অগণিত তরুণ শিক্ষার্থী। তাই রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা ও চাকরি কাঠামোর সংস্কার একান্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি আমাদেরও করণীয় আছে। শুধু চাকরি পাওয়ার জন্যে পড়াশোনার মানসিকতাকে বর্জন করতে হবে। চাকরিতেই যে জীবনের ধমকর্ম নিহিত ও মান-সম্মান জড়িত সে মানসিকতা পরিহার করতে হবে। উদ্যোক্তা হয়ে ব্যবসায় খাতে এগিয়ে আসতে হবে।
নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়ার মতো বৃহত্ মানসিকতা ধারণ করতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ করতে হবে। স্কলারশিপ নিয়ে বিভিন্ন দেশে পড়াশোনা করে মাল্টিন্যাশনাল কোমপানিগুলোকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো করে নিজেদের তৈরি করতে হবে। এসব বিষয় মানসপটে ধারণ করে সরকারি চাকরির প্রতি হা-হুতাশায় না ভুগে যদি পড়াশোনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানার্জন করে যেতে পারি তাহলে আমরা একেকজন রাষ্ট্রের স্কলার হয়ে রাষ্ট্রকে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে সমর্থ হব।
সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক