আজ নবমী। কাল বিদায়। দেশের ৩২ হাজার পূজামণ্ডপ এখন গম গম করছে উৎসব মুখরতায়। ঠাকুর দেখার আনন্দ। মণ্ডপে মণ্ডপে লাউড স্পিকারে গান, ক্ষণে ক্ষণে উলুধ্বনি, মন্ত্রপাঠ, কাঁসর-ঘণ্টার বাদ্য-বাজনা চলছে। কেউ ব্যস্ত পূজা-অর্চনায়, কেউ প্রসদান্নের জন্য হাত পেতে আছেন। কেউ বা ঠাকুরের সাজসজ্জা দেখছে। কেউ আড্ডা দিচ্ছে। ঘুরছে এক ঠাকুর থেকে আরেক ঠাকুরে। রাতে আলোকমালায় একাকার হয়ে ওঠে গোটা পরিবেশ। উমার ফেরার দিন এল ঘনিয়ে। তিন দিন আগেই ‘অকাল বোধনে’ কৈলাশ থেকে তার অধিষ্ঠান হয়েছিল ঠাকুর ঘরে। শরতের পঞ্চমী থেকে দশমী তিথির পাঁচটি দিন পিতৃগৃহ ঘুরে যাওয়া। মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাকের বোলে তাই যেন ধ্বনিত হচ্ছে বাঙালি হিন্দুর আনন্দের জোয়ার। আবার বিষাদের সুরও। গতকাল ছিল মহাষ্টমী বিহিত পূজা। রাতে হয় সন্ধিপূজা। মধ্যাহ্নে ছিল প্রসাদ বিতরণ। রাতে সন্ধিপূজার আগে সন্ধ্যায় হয় আরতি প্রতিযোগিতা। প্রতি বছরের মতো এবারও ঢাকার রামকৃষ্ণ মঠ মিশনে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী কুমারী পূজা। এই মণ্ডপেই গতকাল ঢল নেমেছিল সনাতনধর্মীদের। সকাল আটটা থেকে থেমে থেমে চলছিল উলুধ্বনি। শঙ্খে সুরও তুলছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু তখনো পূজা মঞ্চে আসেনি কুমারী ‘সুভগা’। তবে ভক্তরা সেই কাকভোর থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে এসে জড়ো হতে শুরু করেন মন্দির প্রাঙ্গণে।
এরপর ‘সুভগা’ বসলো পূজা মঞ্চে। পাঁচ বছরের প্রশংসা প্রিয়তা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘সুভগা’ জ্ঞানে দুর্গার আসনে অধিষ্ঠান রেখে ‘সব স্ত্রীলোক ভগবতীর এক একটি রূপ, শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর ‘বেশি প্রকাশ’ এ ভাবনাজ্ঞানে পূজা দেওয়া হয়। সনাতন সংস্কৃতিতে- কুমারী পূজা ছাড়া দুর্গাপূজায় পরিপূর্ণ ফল লাভ হয় না। কুমারী পূজায় দেবীর মঞ্চে অধিষ্ঠানের আগে মন্ত্রোচ্চারণ ও ফুল বেলপাতার আশীর্বাদ পৌঁছে দেওয়া হয় সবার হাতে। এরপর শত শত হিন্দু নারীর উলুধ্বনি আর বিনম্র ভক্তির মধ্যদিয়ে কুমারী পূজা সূচনা হয়। এবারের কুমারী প্রশংসা প্রিয়তা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা প্রিয় শংকর বন্দ্যোপাধ্যায় কে এল জুবলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। মা গায়ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায় ফজলুল হক মহিলা কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। চাইল্ড হ্যাভেন আইডিয়াল হাইস্কুলে প্লে গ্রুপে পড়াশোনা করছে সে। লক্ষ্মীবাজারে তার বাসা। তান্ত্রিকধারা মতে, কুমারী আদ্যাশক্তি মহামায়ার প্রতীক। কামরূপ কামাক্ষ্যা, নেপালের বিভিন্ন মন্দির, বাংলাদেশের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে মূলত কুমারী পূজা হয়ে থাকে।
কুমারী পূজায় রামকৃষ্ণ মিশনের বড়ো চত্বর পেরিয়ে সড়কমালা ছাপিয়ে ছিল ভক্তদের ভিড়। পুরো এলাকা জনারণ্যে পরিণত হয়। সকাল থেকেই নিরাপত্তা রক্ষায় সেখানে বিপুলসংখ্যক পুলিশ, আনসারের পাশাপাশি অন্য গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। ছিল র্যাব সদস্যদেরও কড়া প্রহরা। মিশনের প্রবেশমুখে গোপীবাগ মোড় থেকে গোপীবাগ মাজার পর্যন্ত সড়কে যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। দর্শনার্থী ও পূজারিদের ব্যাপক ভিড়ে টিকাটুলী, পুরোনো ইত্তেফাক মোড়সহ ঐ এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। ঢাকা ছাড়াও রামকৃষ্ণ মিশনের নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল ও দিনাজপুরসহ কয়েকটি মঠ এবং কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী পূজামণ্ডপেও গতকাল কুমারী পূজার আয়োজন করা হয়।