ইন্ধনদাতাদের খোঁজা হচ্ছে: কোটা সংস্কার আন্দোলনে নাশকতা সৃষ্টিতে বিশেষ গোষ্ঠী

বিভাষ বাড়ৈ |

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা রাশেদ খানসহ অন্যদের গ্রেফতারের পর এবার নাশকতা সৃষ্টির মূল ইন্ধনদাতাদের খোঁজা হচ্ছে। কোটা সংস্কারে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা এমনকি কমিটি গঠনের মাধ্যমে কাজ শুরুর পরেও পেছন থেকে বিশেষ গোষ্ঠী ইন্ধন দিচ্ছে বলেই ধারণা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের হলগুলোতে আন্দোলনের নামে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টিতে মাঠে নেমেছে জামায়াতের সংগঠন ইসলামী ছাত্রী সংস্থা। রাতে হলগুলোতে নিজেদের ‘সাধারণ ছাত্রী’ পরিচয় দিয়ে ছাত্রী সংস্থার সদস্যরা লাগাতার অবস্থান নিয়ে ক্যাম্পাস অচল করে দেয়ার জন্য ছাত্রীদের উস্কানি দিচ্ছে। গভীর রাতেও এরাই বাঁশের কেল্লার মাধ্যমে ছড়াচ্ছে মিথ্যা ও উস্কানিমূলক তথ্য। এদিকে বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাসে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচী পালন করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দুই পক্ষ। রাজু ভাস্কর্যের পাশে এক পক্ষের কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছে অধিকাংশ বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা। একই সময়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে পাল্টা মানববন্ধন করেছেন শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ। এ মানববন্ধনে তাদের সঙ্গে ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে এতদিন যুক্ত থাকা অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী। যারা সরকারের উদ্যোগের পরেও কোটা সংস্কারের দাবির নামে চলা আন্দোলনকে উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতা হিসেবে অভিহিত করেছেন। বলেছেন, এখনও যারা কোটা সংস্কারের দাবির নামে আন্দোলন করছেন তাদের ভিন্ন এজেন্ডা আছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছরের এপ্রিলে জোরালো কোটা সংস্কার আন্দোলনে কোন রাজনৈতিক ইন্ধন ছিল কি না তা নিয়ে তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আন্দোলনের অন্যতম নেতা রাশেদ খানকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ এবং বিভিন্নভাবে ছায়া তদন্তও শুরু করেছে পুলিশ। ফেসবুক লাইভে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেয়ার জন্য ছাত্রলীগ নেতা আল নাহিয়ান খান জয়ের তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের করা এক মামলায় রাশেদ খানকে রবিবার গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। রাশেদ সরকারী চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের প্লাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, রাশেদকে আইসিটি এ্যাক্টে গ্রেফতার করা হলেও এখন কাজ চলছে এ আন্দোলনের মূল পরিকল্পনাকারী এবং আন্দোলনের পেছনের কলকাঠি নাড়া ইন্ধনদাতাদের আইনের আওতায় আনতে। ‘কোটা সংস্কার চাই (সব ধরনের চাকরির জন্য)’- ফেসবুকে এমন একটি গ্রুপ ছাড়াও রাশেদ আরও তিনটি ক্লোজড গ্রুপে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের একটির সদস্য (মেম্বার) সংখ্যা ৩০, অপরটিতে ১০। ৩০ জনের ক্লোজড গ্রুপটিতে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা রয়েছেন। ১০ জনের গ্রুপটিতেও আছেন সিনিয়র নেতারা। ওই দুই গ্রুপের চ্যাটবক্সের তথ্য যাচাই-বাছাই করছে পুলিশ।

জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন পরিচালনায় অর্থ তোলার জন্য ১৫ বিকাশ এবং পাঁচটি রকেট এ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এ্যাকাউন্টগুলো খুলে গ্রুপে নম্বর দেয়া হয়েছে। এটা সবাই জানত। যে যার মতো করে টাকা দেয়। টাকা সংগ্রহের পর সেই টাকার পরিমাণ গ্রুপে পোস্ট করা হয়। ওই ২০ এ্যাকাউন্টে অনেকে টাকা পাঠিয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মামুন আহমেদের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কথোপকথনের যে অডিও রেকর্ডটি ভাইরাল হয়েছে তার বিষয়েও তদন্ত চলছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, রিমান্ডে রাশেদ জানান, ফেসবুক লাইভে একটু আবেগপ্রবণ হয়ে এমন বক্তব্য দেন তিনি। দাবি করেছেন, প্রজ্ঞাপন না হওয়ায় আমরা আবারও আন্দোলনের প্রস্তুতি নেই। তবে আমাদের গ্রুপে কোন উস্কানিমূলক পোস্ট দেয়া হয়নি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি-মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেসন্স) মাসুদুর রহমান বলেন, রিমান্ডে নিয়ে রাশেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্ত চলছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে আদালতে পাঠানো হবে।

এদিকে শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতায় অভিযুক্ত হয়ে পড়েছেন আন্দোলনকারীদের বেশ কয়েকজন। জামায়াত-শিবিরের যোগাযোগের তথ্য বেড়িয়ে পড়ার পর বিব্রত এখন অনেক সাধারণ শিক্ষার্থীও। তাদের গ্রেফতারের পর এখন তাই কোটা ইস্যুকে তাদের মুক্তির আন্দোলন বানাতে চায় বিশেষ গোষ্ঠী। বুধবার রাত থেকে ছাত্রীদের হলগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে সংগঠিত করছে ইসলামী ছাত্রী সংস্থার মেয়েরা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগ কাজে লাগিয়ে এরা বড় ধরনের অস্থিরতার চেষ্টা করছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। কোটার দাবি বাদ দিয়ে হলগুলোতে ছাত্রীদের বলা হচ্ছে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির জন্য প্রয়োজনে ক্যাম্পাস অচল করে দিতে হবে।

এর আগে গত কয়েক বছর ধরেই প্রমাণ মিলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের হলগুলোতে নীরবে সংগঠিত হচ্ছে ছাত্রী সংস্থা। গত দুই বছরে হলগুলোতে তৎপরতার জন্য আটক ও বহিস্কারও হয়েছে ছাত্রী সংস্থার বহু সদস্য। এরা কয়েক বছর ধরেই গ্রুপ স্টাডির নামে মেয়েদের দলে ভেড়াচ্ছে। জামায়াতের ছাত্রী সংগঠন ‘ছাত্রী সংস্থা’ সন্ত্রাসীদের মগজ ধোলাই এবং আত্মঘাতী বাহিনী তৈরির কাজ করছে বলেও বিভিন্ন সময় তথ্য মিলেছে। পাশাপাশি জেএমবি’র নারী সদস্যদের তহবিল গঠনের জন্যও সাহায্য করে যাচ্ছে এই ছাত্রী সংস্থা। এমনকি যাকাত, ফিতরা, দান-খয়রাত ও গরিবদের সাহায্য করার কথা বলে এই ইয়ানত সংগ্রহের দেখ ভালও করে তারা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ঢাবিতে ইসলামী ছাত্রী সংস্থার নারী সদস্যরা নীরবে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। তারা ইয়ানত সংগ্রহ, সংগঠনের প্রচারণা ও সদস্য সংগ্রহের কাজ করে যাচ্ছে। তাদের তৎপরতার তথ্য মিললেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ঢাবিতে এরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারেই সব সময় কাজ করে। যে কোন সরকারবিরোধী কর্মসূচী পেলে এরা যোগ দেয় এবং জামায়াত-শিবিরেরর ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে এরা উস্কানিমূলক তথ্য ছড়ায়।

বুধবার রাতেই বিভিন্ন হলে ছাত্রীদের লাগাতার অবস্থান নেয়ার পরিকল্পনা ছিল বলে তথ্য দিচ্ছেন অনেক সাধারণ ছাত্রী। রাতে শামসুন্নাহার হল, রোকেয়া হলসহ কয়েকটি হলে মধ্য রাতে হঠাৎই জড়ো করা হয় সাধারণ কিছু ছাত্রীকে। এরপর একের পর এক পোস্ট দেয়া হয় বাঁশের কেল্লায়। রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানানো হয় বারবার। বলা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল, আপনারা সকল হল থেকে নেমে আসেন’। বলা হয়, ‘সকলে নেমে পড়লে কেবল কোটা নয়, এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানো সময়ের ব্যাপার মাত্র’। বুধবার রাতের পর থেকে প্রতি মুহূর্তে বাঁশের কেল্লায় দেয়া হচ্ছে উস্কানিমূলক নানা পোস্টার। সূত্রগুলো বলছে, ছাত্রী সংস্থার মাধ্যমে হলে নতুন করে সঙ্কটের আশায় কাজ করছে জামায়াত-শিবির। এজন্য তারা ব্যবহার করছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচী পালন করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দুটি পক্ষ। রাজু ভাস্কর্যের পাশে এক পক্ষের কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছে অধিকাংশ বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা। একই সময়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে পাল্টা মানববন্ধন করেছেন শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ।

এখন ‘অযৌক্তিক আন্দোলনের’ মাধ্যমে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’র ব্যানারে রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমাবেশ করছেন শিক্ষার্থীদের এক পক্ষ। সাধারণ শিক্ষার্থীর পাল্টা মানববন্ধনে ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে শুরুর থেকে অংশ নেয়া এমনকি সংঘর্ষে আহত তানভীর হাসান সৈকত। তিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন। কর্মসূচীতে আরও ছিলেন শাহরিয়ার সাকিল, খাদিজা আক্তার, সনিয়া ইসলাম, কামাল উদ্দিন, আবু বকর, মাহবুব আলম প্রমুখ।

তানভীর হাসান সৈকত তাদের অবস্থান সম্পর্কে বলেছেন, আমরা কোটা সংস্কারের পক্ষে। এ আন্দোলন করতে গিয়ে আমরা আহতও হয়েছি। সরকার আমাদের দাবি মেনে নিয়েছে। সে অনুসারে কাজও চলছে। কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা মনে করি এরপরেও যারা দাবি তোলার নামে আন্দোলন করছেন তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। এখন যারা আন্দোলন করছেন আমরা মনে করি তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সফলতা চায় না। তারা চায় অস্থিরতা। এদের নেতারা শিবিরের বাঁশের কেল্লার মাধ্যমে অপপ্রচার চালাচ্ছে। নাশকতায় উস্কানি দিচ্ছে। তাদের নেতা রাশেদের সঙ্গে শিবিরের বাঁশের কেল্লার প্রতিমুহূর্তের যোগাযোগ কিভাবে হচ্ছে তা দেখা দরকার।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর হামলা ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে আরেক পক্ষ মিছিল করেছেন। দুপুরে ‘নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই’ ব্যানারে এই মিছিল বের করেন দুই হলের ছাত্রীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে অপরাজেয় বাংলা হয়ে দুপুর সোয়া বারোটার দিকে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এসে দাঁড়ায়। এ সময় ‘এসো ভাই এসো বোন গড়ে তুলি আন্দোলন’, ‘আমার ভাই মার খেল কেন? প্রশাসন জবাব চাই’ বলে স্লোগান দেন ছাত্রীরা। এদিকে সম্প্রতি হামলার শিকার শিক্ষার্থী মরিয়ম মান্নান ওই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেছেন। তার প্রশ্ন, যাদের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি লাঞ্ছিত হয়েছেন, সেই শিক্ষার্থীরা এখন কোথায়?

রোকেয়া হলের সামনে সংবাদ সম্মেলনে এ প্রশ্ন করেন মরিয়ম মান্নান। মরিয়ম মান্নান বলেন, যাদের জন্য তিনি লাঞ্ছিত হলেন, জামায়াত-শিবির হিসেবে ‘অপবাদ’ পেলেন, তারা আজ কোথায়? এ লাঞ্ছনার তিনি বিচার দাবি করেন।

 

সৌজন্যে: জনকণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034270286560059