সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী, সময়োপযোগী ও উন্নয়নমূলক সিদ্ধান্তের একটি হলো 'বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ' (এনটিআরসিএ) কর্তৃক মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। 'ম্যানেজিং' কমিটি কর্তৃক শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, ঘুষ-বাণিজ্য, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বন্ধ ও মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহ সৃষ্টির বিচারে ভালো একটি সিদ্ধান্ত এটি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে সরকার প্রকৃত মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আসার সুযোগ করে দেওয়ায় নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি বৃদ্ধি পাবে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বিষয়ভিত্তিক যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ পাবেন, প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন হবে, নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমবে এবং সর্বোপরি, দরিদ্র পরিবারের অদম্য মেধাবীরা নিরাশায় ভুগবে না। বরং নতুন উদ্যমে পড়ালেখার শক্তি পাবে। কেননা 'ম্যানেজিং' কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের অর্থ হলো- অর্থের কাছে মেধার, প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে দারিদ্র্যের ও লোভের কাছে সম্মানের পরাজিত হওয়া।
দুই. গত ২৮ জুন ২০১৮ জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সভায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এনটিআরসিএর মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ায়- ক. দীর্ঘসূত্রতা; খ. নতুন পদ্ধতিতে দলীয় অথবা পছন্দের লোকদের নিয়োগ দিতে না পারা; গ. দূর-দূরান্তে নিয়োগ দেওয়া; ঘ. যে প্রতিষ্ঠানের জন্য আবেদন করা হয়নি, সেখানে নিয়োগ দেওয়া; ঙ. এক বিষয়ের শিক্ষককে অন্য বিষয়ে নিয়োগ দেওয়া; চ. পদ শূন্য না থাকা সত্ত্বেও ওই পদে নিয়োগ দেওয়া প্রভৃতি কারণ দেখিয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা পুনরায় 'ম্যানেজিং' কমিটির হাতে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। কারণগুলো যৌক্তিক হলেও বিষয়টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। কেননা, সত্যিকার অর্থেই 'ম্যানেজিং' কমিটির কাছে নিয়োগের কর্তৃত্ব ফেরত গেলে শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, দুর্নীতি বাড়বে; শিক্ষার মানের অবনতি ঘটতে থাকবে এবং কাঙ্ক্ষিত মানের মেধাবী, দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের পরিবর্তে অদক্ষ, অযোগ্য এবং তুলনামূলকভাবে স্বল্প শিক্ষিত মানুষ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবেন, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। একজন শিক্ষকের বিষয়গত জ্ঞান, পারদর্শিতা, দক্ষতা, প্রশ্নোত্তর, যুক্তি প্রদান ও খণ্ডনে সক্ষমতা, ভাষাগত দক্ষতা, উপস্থাপনা ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো ভালোভাবে এবং অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ ও যাচাইয়ের প্রয়োজন রয়েছে। কেননা শিক্ষার্থীর শিক্ষা-দীক্ষার ভিত্তিভূমি রচিত হয় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। কলেজ পর্যায়ে তা শানিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বমানের জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য। ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে ঢালাওভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার যে রীতি প্রচলিত ছিল, তাতে একদিকে যেমন মেধা যাচাইয়ের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো সুযোগ নেই; অন্যদিকে অনেকাংশেই মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ না পাওয়ার একটা ক্ষেত্র তৈরি হয় রাজনৈতিক চাপ, স্বজনপ্রীতি, এলাকাপ্রীতি, কমিটি কর্তৃক দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। একাডেমিক, দর্শনগত, আদর্শগত, নৈতিক দিক দিয়ে দুর্বল মানের শিক্ষক নিয়োগের কারণে শিক্ষার্থীরা নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগবঞ্চিত এবং একই সঙ্গে অনায়াসে পথভ্রষ্ট হচ্ছে। গত ২৪-২৬ জুলাই, ২০১৮ অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনের আগে কয়েকজন জেলা প্রশাসক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি কমে যাওয়া এবং মেধাবী শিক্ষক নিয়োগের সম্ভাবনার যুক্তিতে এনটিআরসিএর মাধ্যমে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, প্রভাষক ও সহকারী শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব জমা দেন। কেননা মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা তাদের ভালো রয়েছে।
তিন. গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বিজ্ঞান শিক্ষা জাদুঘরে যাওয়ার মতো অবস্থায় উপনীত হয়েছে। মানসম্মত লাইব্রেরি নেই, বিজ্ঞানাগার নেই, ইংরেজি, বিজ্ঞান (পদার্থ, রসায়ন, জীব), উচ্চতর গণিত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি), এমনকি প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ জানা ভালো শিক্ষক নেই। বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞানার্জনের জন্য বিজ্ঞানাগার থাকাটা আবশ্যক। আর না থাকলে বিজ্ঞান শিক্ষা অর্থহীন। দেশের শহর এলাকার শিক্ষার্থীরা যা হাতে-কলমে শিখছে, গ্রামের শিক্ষার্থীদের কাছে তা দিবাস্বপ্নের মতো। ব্যানবেইসের সম্প্রতি প্রকাশিত 'বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস-২০১৭' প্রতিবেদনে প্রকাশ, দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানাগার না থাকায় ব্যবহারিক বিজ্ঞান শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। 'সেভ দ্য চিলড্রেন'-এর 'চাইল্ড পার্লামেন্ট' শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানাগার না থাকা এবং ব্যবহারিক ক্লাস না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞানের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জরিপে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ৬১.৭ শতাংশ বলেছে, তাদের কোনো ব্যবহারিক ক্লাস হয় না এবং ৩৯ শতাংশ বলেছে, বিজ্ঞানাগারের জন্য তাদের অতিরিক্ত ফি পরিশোধ করতে হয়। আবার অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানাগার আছে; কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে খেলতে ও খেলাতে পারে এমন শিক্ষক নেই। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রাংশের নাম ও ব্যবহার শিক্ষক জানেন না; তাই স্বাভাবিকভাবে শিক্ষার্থীরাও জানে না। তাছাড়া সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল হওয়ায় এবং উন্নত জীবনযাপনের আশায় মেধাবী শিক্ষক গ্রামে থাকছেন না।
চার. গত ২৬ জুন ২০১৬ সরকারি কর্মকমিশনে (পিএসসি) অনুষ্ঠিত এক সভায় দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সংকট দূর করতে ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কিন্তু ক্যাডার পদ পাননি, এমন প্রার্থীদের (নন-ক্যাডার) মধ্য থেকে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ৩৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়া এ প্রার্থীরা সংখ্যায় ছিলেন মোট ৮৯৮ জন। ক্যাডার পদ পাননি এমন প্রার্থীদের মেধা অনুযায়ী প্রথম শ্রেণি (নন-ক্যাডার) মর্যাদায় উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের 'প্রধান শিক্ষক'; সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেধা অনুযায়ী 'সহকারী প্রধান শিক্ষক', বিষয়ভিত্তিক 'সহকারী শিক্ষক' এবং সরকারি কলেজগুলোতে বিষয়ভিত্তিক 'প্রভাষক' হিসেবে নিয়োগ দিতে পারলে শিক্ষা একদিকে যেমন প্রকৃত প্রস্তাবে জাতির মেরুদণ্ডে পরিণত হবে, অন্যদিকে মেধা যাচাইয়ের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীকে তাদের পরিশ্রমের যোগ্য সম্মান করা হবে।
পাঁচ. 'এনটিআরসিএ' কর্তৃক শিক্ষক নিয়োগ চালু রেখে কিছু বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন- ১. বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে পিএসসির আদলে স্কুল-কলেজে কেন্দ্রীয়ভাবে 'শিক্ষক নিয়োগ কমিশন' গঠন ও তার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা দরকার; ২. প্রতিবছর চাহিদা অনুযায়ী নভেম্বর মাসের মধ্যে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া জরুরি; ৩. নিয়োগের আগে বহুমুখী গোয়েন্দা প্রতিবেদন (সিআইডি, ডিবি, এসবি, এনএসআই, ডিজিএফআই) সংগ্রহ ও বিশ্লেষণপূর্বক নিয়োগ দেওয়া গেলে সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ের সমাধান হতে পারে; ৪. অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, প্রভাষক এবং সহকারী শিক্ষক পদগুলোর ক্ষেত্রে নিজ এলাকার বাইরে নিয়োগের ব্যবস্থা করা গেলে সুফল বেশি পাওয়া যেতে পারে; ৫. অবশ্যই পদোন্নতি, পদায়ন, সংযুক্তি ও বদলির সুযোগ সংরক্ষণসহ এবং একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনধিক পাঁচ বছরের বেশি সময় না থাকার ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন; ৬. শূন্যপদ অধিক গুরুত্বের ভিত্তিতে পূরণ করা দরকার; ৭. স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বিষয়ভিত্তিক মেধাবী শিক্ষার্থী নিয়োগে অধিক গুরুত্ব দেওয়া দরকার; ৮. পাশাপাশি স্কুল-কলেজে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদোন্নতি এবং সুযোগ-সুবিধা নিয়েও ভাবতে হবে; ৯. তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের সরকারি কলেজগুলোতে পিএসসির অধীনে বিসিএসের মাধ্যমে প্রচলিত নিয়োগ ব্যবস্থা যেন বহাল থাকে।
প্রতিটি জেলায় প্রতিবছর গণিত ও বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড এবং বিজ্ঞান মেলা আয়োজন করার মাধ্যমে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রেষণা (মোটিভেশন) সৃষ্টি করা দরকার। একাডেমিক কার্যক্রম ও ক্লাস রুটিন যেন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য কষ্টকর ও স্বাস্থ্যহানিকর না হয় এবং এক এলাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই রকম হয়, সেদিকটিতে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। সরকার সম্পূর্ণ বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ করে দেওয়া সত্ত্বেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্রীদের কাছ থেকে এবং সব শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বিভিন্ন ফি ধার্যের নামে অর্থ আদায় করে থাকে, যা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। জবাবদিহি, দায়বদ্ধতা ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকা দরকার শিক্ষার প্রতিটি স্তরে। শিক্ষাকে শৈল্পিক ও বৈশ্বিক মানে উন্নীত করে আরও জীবন ও জীবিকামুখী করা দরকার। মূল্যবোধসম্পন্ন ও বিবেকবান শিক্ষক প্রত্যাশা করার আগে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রচলিত শিক্ষা নীতিমালা, শিক্ষাব্যবস্থায়ও সময়োপযোগী মৌলিক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এ দেশ ধন-ধান্যে, পুষ্পে, জ্ঞানী আর গুণীতে, শিক্ষায়, গৌরবে, মানবতায়, উদারতায়, মনুষ্যত্ববোধে পরিপূর্ণ হোক, তা আমরা সবাই চাই। সে স্বপ্নও দেখি। শিক্ষাক্ষেত্রের টেকসই উন্নয়নের জন্য অধিকতর কার্যকর ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার বিকল্প যে নেই, তা আমাদের সময়মতো বুঝতে হবে। সোনার বাংলায় মূল্যবোধ, নৈতিকতা, দেশপ্রেম, মানবিকতার অভাব নেই। অভাব হলো পরিচর্যার। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার পর একটি স্বনামধন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'তোমার বিশ্ববিদ্যালয় কি এমপিওভুক্ত? যা বোঝার আমি বুঝেছিলাম। বাকিটা বোঝার দায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, জেঝিয়াং ইউনিভার্সিটি চীন এবং শিক্ষক, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ
সূত্র: সমকাল