শিক্ষক যে স্তরেরই হোক প্রথম শ্রেণির মর্যাদা চাই

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

প্রাইমারি স্কুলে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির যোগ্যতা স্নাতক পাস নির্ধারণ করা হচ্ছে। সভাপতির ছেলে কিংবা মেয়ে সংশ্লিষ্ট স্কুলে অধ্যয়নরত থাকতে হবে। কথাটি যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে। ছেলেমেয়ে স্কুলে অধ্যয়নরত না থাকলে স্কুলের জন্য সভাপতি কিংবা সদস্য কারো দরদ থাকে না। স্কুল কমিটিতে এক রকম উড়ে এসে জুড়ে বসা স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাধ্যমিক এবং কলেজ পর্যায়েও একই অবস্থা। এমপি সাহেবের মনোনীত যে কেউ কমিটির সভাপতি হতে পারেন। শিক্ষানুরাগীও বাইরে থেকে আসেন। এক্ষেত্রে সন্তান শিক্ষার্থী হিসেবে থাকা বা না থাকার প্রশ্ন নেই। এমনকি এলাকার বাইরের লোকজনও কমিটিতে এসে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্কুলের লেখাপড়া কিংবা উন্নতির দিকে এদের খেয়াল থাকে না। তাই যিনি যে স্কুল কমিটির সভাপতি হবেন, তিনি সেই স্কুলের একজন ছাত্র বা ছাত্রীর পিতা কিংবা মাতা হবেন-এ বাধ্যবাধকতা শিক্ষায় ইতিবাচক সুফল বয়ে আনবে। শিক্ষার সর্বক্ষেত্রে এরকম নিয়ম চালু করা দরকার। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কমিটির সভাপতি স্নাতক পাস হবেন-সে কথাটি কেন জানি পছন্দ হয়নি। পছন্দ হয়নি এজন্য যে, এখনও আমাদের দেশে অনেক এলাকা আছে যেখানে স্নাতক পাস লোকই পাওয়া কঠিন। সেসব এলাকার স্কুলগুলোতে কারা সভাপতি হবেন? প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি স্নাতক পাস বাধ্যতামূলক হলে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ সমূহের কমিটির সভাপতির শিক্ষাগত যোগ্যতা কতটুকু হওয়া উচিত?  সেই হিসেবে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর বা সমমান এবং কলেজে পিএইচ ডিগ্রিধারী লোকদের সভাপতি করতে হবে। দেশে এত মাস্টার ডিগ্রি আর ডক্টরেট ডিগ্রিধারী লোক নেই।

আরও পড়ুন: শিক্ষকদের ওপর অর্ধশিক্ষিতরা প্রভাব খাটালে জ্ঞান চর্চার পরিবেশ থাকে না : শিক্ষা উপমন্ত্রী (ভিডিও) 

প্রাইমারি স্কুলে যিনি সভাপতি হবেন, তার সন্তান স্কুলে পড়ুয়া হতে হবে। এটি আমার কাছে এক চমৎকার আইডিয়া মনে হয়েছে। অন্তত নিজের সন্তানের কথা ভেবে হলেও সভাপতি সাহেব লেখাপড়ার পড়ার মান বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হবেন। স্কুলের দিকে খেয়াল রাখবেন। শিক্ষকদের খোজঁ-খবর নেবেন। সপ্তাহে এক-দুই বার হলেও স্কুলে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে আসবেন। 
গত কয়েকদিন যাবত প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকরা বেতন বৈষম্য নিরসনের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারের সেদিকে তেমন একটা নজর নেই বলে মনে হয়। সামনে সমাপনী ও বার্ষিক পরীক্ষা। শিক্ষকরা পরীক্ষা বর্জনের হুমকি দিয়েছেন। তবু সরকারের এতটুকু টনক নড়ছে না। গত জাতীয় নির্বাচনের সময় এ নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি ভয়েস কল শিক্ষকদের উজ্জ্বীবিত করেছিল। এখন তারা অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাই তারা চূড়ান্ত আন্দোলনে যাবার আগে অন্তত একবারের জন্য হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পেতে চান।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের সমিতি এখন আর আগের মতো খুব একটা শক্তিশালী নেই বলে মনে হয়। তাদের মধ্যে এখন বিভাজন। সহকারী ও প্রধানদের আলাদা আলাদা সংগঠন। আগে তাদের শক্ত অবস্থানের কারণে যে কোনও দাবি-দাওয়া সহজেই পূরণ হয়ে যেত। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে প্রাথমিকের শিক্ষকেরা কত না শক্তিশালী ছিলেন। 

কোনও কোনও দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা দেয়া হয়। আমাদের দেশে প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেবার কথা বলে আজও দেয়া হয়নি। এ কথা বলে কী সহকারী শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণিতে ঠেলে নামিয়ে দেয়া হলো না? এটি সত্যি অমর্যাদাকর। দুঃখজনকও বটে। শিক্ষক তিনি যে স্তরের হউন না কেন, প্রথম শ্রেণির মর্যাদা সম্পন্ন হবেন। শিক্ষক মর্যাদাবান না হলে জাতি মর্যাদার আসনে উন্নীত হয় কী করে?

শিক্ষকের মান সম্মত জীবনমান নিশ্চিত করলে শিক্ষকের মর্যাদা আপনাআপনি প্রতিষ্ঠিত হয়। আর শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা গেলে শিক্ষার মান নিশ্চিত করা সম্ভব। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনিও সেদিন বলেছেন,' শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা সম্ভব নয়'। আসলে আমাদের আজ মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা খুব বেশি দরকারি হয়ে উঠেছে। মানসম্মত শিক্ষা না হবার কারণে আমাদের শিক্ষা আজ সারা দুনিয়ায় অবহেলিত।

দৈনিক শিক্ষায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক কয়েকটি প্রতিবেদনে জানলাম, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি স্নাতক আর সদস্যরা এসএসসি পাস হবেন মর্মে নীতিমালা করা হচ্ছে। মাধ্যমিক স্তর ও কলেজ স্তরসহ শিক্ষার সব জায়গায় কমিটিতে অশিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিতদের প্রবেশাধিকার রহিত করা দরকার। এদের কারণে শিক্ষায় পিছু টান পড়ে। আমাদের শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার নওফেল হাসান মহোদয় সেই সত্যটি উপলব্ধি করে বলেছেন, 'শিক্ষকদের উপর অর্ধ শিক্ষিতরা প্রভাব খাটালে জ্ঞান চর্চার পরিবেশ থাকে না'। এই নিরেট সত্য কথাটি সবার উপলব্ধি করা উচিত।

নীতি-নৈতিকতা ও মানবিকতার আজকাল বড়ই আকাল। লেখাপড়া শেখা অনেক উচ্চ শিক্ষিত লোকজনের মধ্যেও এসব গুণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিন আগে এমপি বুবলী কী কাণ্ডটাই না ঘটিয়ে বসলেন। বিএ পাস করা কী তার জন্য খুব অপরিহার্য্য ছিল? অপরিহার্য্য হলেও অনৈতিক পথে যেতে হবে কেন? এ গর্হিত কাজটি করে তিনি কেবল তার বংশের মুখে কালি দেননি, সাংসদ হবার কারণে গোটা জাতিকে কবর দিয়ে ফেলেছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সাহেবের সম্প্রতি যুবলীগের সভাপতি হবার খায়েশ ব্যক্ত হবার পর তার নীতি নৈতিকতার বিষয়টি নিয়ে যে কারো মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। অন্য আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের কাণ্ড-কারখানা সত্যি আমাদের ভাবিয়ে তোলে। তারা দুর্নীতি, স্বজন প্রীতি, নিজের ভাই-ভাতিজাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়াসহ নানা কাজে লাগামহীন। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত এসব লোকজনের কায়-কারবার দেখে সত্যি লজ্জায় বাঁচি না।

আমাদের কোনও কোনও স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির কারণে সবার মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু শিক্ষক নামধারী ব্যক্তি তাদের মেয়ের মতো ছাত্রীদের ওপর যৌন লালসা চরিতার্থ করতে মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না। তাদের কারণে গোটা জাতির মুখ ছোট হয়ে যায়। ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাতের ওপর তারই মাদরাসার অধ্যক্ষের লেবাসধারী পশুরূপ সিরাজ উদ দৌলার যৌন লালসা চরিতার্থ করার অপকর্মটি ভোলার মতো নয়। সিরাজ ও তার সহযোগীদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। রায়টি দ্রুত কার্যকর হলে আমরা লজ্জা থেকে কিছুটা হলেও বেঁচে যাই।

স্কু্ল, কলেজ ও মাদরাসা এমপিওভুক্তি নিয়ে অনেক হইচই হয়েছে। অবশেষে দুই হাজার সাতশ ত্রিশটি প্রতিষ্ঠান এমপিও নামের সোনার হরিণ ধরতে পেরেছে। কিছু কিছু অযোগ্য প্রতিষ্ঠান এমপিও পেয়েছে বটে। তারাও একদিন যোগ্যতা অর্জন করবে। এক ব্যক্তির চায়ের দোকান বিক্রির টাকায় তৈরি করা স্কুল এমপিও পেয়েছে। সংবাদটি নিঃসন্দেহে আমাদের আনন্দ দিয়েছে। অনেক মন্ত্রী-মিনিস্টার, এমপি কিংবা রাজনৈতিক নেতার স্কুল কলেজও এমপিও পায়নি। খোদ শিক্ষামন্ত্রীর ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানও। রাজনৈতিক বিবেচনা না করায় শিক্ষামন্ত্রীকে অশেষ ধন্যবাদ। অন্তত আমাদের শিক্ষায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এভাবে জোরদার থাকা দরকার।

লেখক :  অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির - dainik shiksha অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027260780334473