শিক্ষককে হতে হয় গবেষক

শরীফুল্লাহ মুক্তি |

আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। আর বাধ্যতামূলক এ প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের শিক্ষাক্রমটি হলো যোগ্যতাভিত্তিক। কিন্তু এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু যা অর্জন করার কথা অধিকাংশ শিশু তা অর্জন করতে পারছে না। আবার ভর্তিকৃত সব শিশু প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপন করছে না, একটা অংশ ঝরে পড়ছে। আবার যারা করছে তারাও সফলভাবে করতে পারছে না। শিশুরা কেন পারছে না? শ্রেণিকক্ষে আসলে কী ঘটছে? শ্রেণিকক্ষের সব শিশুই কি একইভাবে শিখতে পারছে? শ্রেণিকক্ষে শিশুদের যোগ্যতা অর্জন না করার কারণ কী হতে পারে? কেন আমরা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি না? কোথায় সমস্যা? কোথায় কাজ করা দরকার? কোথায় উন্নয়ন আবশ্যক? এর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা এবং যথাযথ উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।

শিক্ষক হলেন শিক্ষাকে বাস্তব রূপদানকারী। সাধারণভাবে শিক্ষা প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত, বাস্তবায়ন ও ছড়িয়ে দেয়ার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিই হলেন শিক্ষক। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা, পাশাপাশি জটিলও বটে। এই পেশার উন্নয়নে জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন সর্বাগ্রে। একজন শিক্ষককে তার পেশার উন্নয়নের স্বার্থে প্রতিনিয়ত নব নব জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে হয়। শিখন-শেখানো কার্যক্রম শতভাগ সফল করতে হলে জ্ঞান-গবেষণার সন্ধানে নিরলস প্রচেষ্টায় শিক্ষককে মত্ত থাকতে হয়। শিক্ষককে প্রতিনিয়ত জ্ঞান ও দক্ষতার উন্নয়ন সাধনে সচেষ্ট থাকতে হয় এবং যথাসময়ে যথোপযুক্ত স্থানে প্রায়োগিক দিকের প্রতি নজর দিতে হয়। কিন্তু এটি সহজ কর্ম নয়। একজন শিক্ষককের পক্ষে কীভাবে এ যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব? বিষয়টি নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে। আর হাত গুটিয়ে বসে থাকার সময় নেই। শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে শিশুদের না শেখার কারণ ও এর প্রতিকারের উপায় জানা একজন শিক্ষকের জন্য অতীব জরুরি। সে জন্য শিক্ষককে হতে হবে একজন গবেষক। তিনি সব সময় ছোট ছোট কর্মসহায়ক গবেষেণা পরিচালনা করে নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করবেন এবং সেই অভিজ্ঞতা পেশাগত জীবনে কাজে লাগাবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। সত্যি কথা বলতে কি- অধিকাংশ শিক্ষকই বিষয়টি এভাবে চিন্তা করেন না।

যখন কোন শিক্ষা-সমস্যা বা শিক্ষা-সম্পর্কিত বিষয়বস্তুকে পদ্ধতিগত ও শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে অনুসন্ধান করা হয় তখন তা হয় শিক্ষা-গবেষণা। শিক্ষা-গবেষণার লক্ষ্য হলো শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে (যেমন : শিক্ষণ, শিখন, শিক্ষাক্রম, শিক্ষার্থী মূলায়ন, পেশাগত দক্ষতা, শিক্ষক যোগ্যতা, শিক্ষা পদ্ধতি/কৌশল, টেক্সট বই ইত্যাদি) অজানা সত্য উদ্ঘাটন, নীতি বা তত্ত্বের বিকাশ, সংশোধন বা উন্নয়নে অবদান রাখা। যে সব গবেষণা থেকে শিক্ষাবিষয়ক কোন নতুন তত্ত্ব বিকাশ লাভ করে তা মৌলিক গবেষণা (basic research) নামে পরিচিত। আর যে সব গবেষণায় কোন তত্ত্ব বা নীতি পরীক্ষা করা হয় বা সংশোধন/পরিবর্তন করা হয় তা হলো ব্যবহারিক গবেষণা (applied research)। যেমন- জ্যাঁ পেয়াজের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সম্পর্কিত তত্ত্ব মৌলিক গবেষণার ফল, আবার শ্রেণিকক্ষে এর ব্যবহারযোগ্যতা পরীক্ষা করা ব্যবহারিক গবেষণার কাজ।

শিক্ষা-গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়ার মানের উন্নয়ন সাধন করা বা এর সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান করা। যেমন- গতানুগতিক শিক্ষণ পদ্ধতির (teaching method) পরিবর্তন করে শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক (child-centred) পদ্ধতি প্রবর্তন করা, মুখস্থ-নির্ভর প্রশ্নপত্রের মান উন্নয়ন করে উচ্চচিন্তা সহায়ক প্রশ্ন (যেমন- যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন/সৃজনশীল প্রশ্ন) ব্যবহার করা। শ্রেণিকক্ষের দৈনন্দিন শিক্ষণ-শিখন সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধান শিক্ষার্থীদের শিখন-মান উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে গতানুগতিক গবেষণা (যেমন-জরিপ, পরীক্ষণমূলক ইত্যাদি) এ ধরনের পরিবর্তন বা উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরাসরি সহায়ক নয়। এ জাতীয় গবেষণা প্রকৃতিগতভাবে শ্রেণিকক্ষের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন; শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক, শিক্ষার্থীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্যার সমাধান বা পেশাগত উন্নয়ন গতানুগতিক গবেষণার আওতাভুক্ত নয়। গবেষণাকে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কিত করার জন্য, শ্রেণিকক্ষের সমস্যা শনাক্ত করে তা সমাধানের পথ-নির্দেশনার জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে কার্যোপযোগী গবেষণা ধারার (action research paradigm) সূচনা হয়। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিথষ্ক্রিয়ার (teaching-learning interaction) মানোন্নয়নে কার্যোপযোগী গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গত কয়েক দশক যাবৎ উন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় ধরনের দেশ তথা সমাজেই শিক্ষা-সমস্যা সমাধানে কার্যোপযোগী গবেষণা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। Stuard (1994) বেশ জোরের সঙ্গে বলেছেন যে কার্যোপযোগী গবেষণা উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার মান নিশ্চিত করার জন্য একটি কার্যকর উপায়। আমাদের দেশের শ্রেণিকক্ষের শিক্ষণ-শিখনের মানোন্নয়নের জন্য কার্যোপযোগী গবেষণার প্রয়োগ খুবই প্রয়োজন। এ বিষয়ে শ্রেণি-শিক্ষককে এ গবেষণা সম্পর্কে জানা এবং প্রয়োগের দক্ষতা বিকাশ খুবই জরুরি।

Research- এর আভিধানিক বাংলা হলো ‘গবেষণা’ বা ‘সযত্ন অনুসন্ধান’। আর এর সমার্থক যে সব ইংরেজি প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে রয়েছে ’investigation’, ’enquiry’, ’studz’ ইত্যাদি। সাধারণভাবে গবেষণা হলো কোন বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সযত্ন ও নিবিড় অনুসন্ধান’। Plano Clark এবং Creswell এর মতে ’Research is a process of steps used to collect and analyze information in order to increase our understanding of a topic or issue’। অর্থাৎ, গবেষণা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে কোন বিষয় সম্পর্কে ভালোভাবে জানার জন্য ঐ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়। শিক্ষাবিদ ও গবেষকের মতে গবেষণা প্রক্রিয়াটি এলোমেলো বা অনিয়মিত কোন প্রক্রিয়া নয়; এটি একটি নিয়মতান্ত্রিক বা পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া। গবেষণার পরিসর ছোট বা বড় দুই-ই হতে পারে। সাধারণত একটি গবেষণা প্রক্রিয়া তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রথমত অনুসন্ধানের জন্য প্রশ্ন উত্থাপন বা সমস্যা চিহ্নিত করা, দ্বিতীয়ত প্রশ্নের উত্তর লাভ বা সত্য উদ্ঘাটনের জন্য তথ্য সংগ্রহ করা এবং তৃতীয়ত প্রশ্নোত্তর বা উদ্ঘাটিত সত্য প্রতিবেদনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা।

‘কার্যোপযোগী’ ও ‘গবেষণা’ এই শব্দ দু’টি থেকেই ‘কার্যোপযোগী গবেষণা’-এর অর্থ উপলব্ধি করা সম্ভব। ‘কার্যোপযোগী’ শব্দটি বিশ্লেষণ করে আমরা বলতে পারি যা কাজের সহায়ক বা যা থেকে কার্য সম্পাদনের দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়। আর ‘গবেষণা’ বলতে কী বুঝায় তা পূর্বে কিছুটা বর্ণনা করা হয়েছে। সমার্থক শব্দ কর্মসহায়ক বা কর্মোন্নয়ন গবেষণার মাধ্যমেও এর যথাযথ অর্থ ধারণা করা যেতে পারে। শিক্ষাবিদগণ কর্যোপযোগী গবেষণাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষাবিদের প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুসরণ করে বলা যায় যে, কার্যোপযোগী গবেষণা এমন একটি পদ্ধতিগত অনুসন্ধান প্রক্রিয়া যা দ্বারা পেশাদার ব্যক্তি তাদের নিজ কর্ম, অবস্থা বা সমস্যা চিহ্নিত করে তা উন্নয়ন বা সমাধানে সচেষ্ট হন; নিজ উদ্যোগে পদ্ধতিগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে সম্ভাব্য সমাধান বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন আনা বা উন্নতি সাধন এ গবেষণার একটি অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়া।

কার্যোপযোগী গবেষণাকে সামাজিক পরিবেশে পেশাগত অনুসন্ধানের একটি বাস্তবসম্মত পদ্ধতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্য কথায় শ্রেণি-শিক্ষক প্রতিদিন যে বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি হন তার সমাধানে এ গবেষণা সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এই গবেষণায় একজন শ্রেণি-শিক্ষক প্রতিফলনমূলক চিন্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজ কার্যাবলি বাস্তবে নীরিক্ষা করে এর উন্নয়ন ঘটাতে সচেষ্ট হন। অর্থাৎ, কার্যোপযোগী গবেষণা হলো নিজের সম্পর্কে নিজের অনুসন্ধান, আর এর কেন্দ্রে রয়েছে আত্ম-প্রতিফলন (self-reflection)। এ গবেষণায় একজন শিক্ষক নিজ অবস্থা উন্নয়নে নিজে গবেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন, বা অন্যান্য বিশেষজ্ঞ গবেষকের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে এই গবেষণা পরিচালনা করতে পারেন। এখানে উল্লেখ করার করার মতো বিষয় হলো গতানুগাতিক গবেষণার শিক্ষক, শিক্ষার্থী বহিরাগত বিশেষজ্ঞ গবেষকের তথ্যদাতা হিসেবে বিবেচিত হয়, কিন্তু কার্যোপযোগী গবেষণায় শিক্ষক নিজে গবেষকের ভূমিকা পালন করেন। কোনো শিক্ষক এককভাবে এ গবেষণা করতে পারেন। আবার একাধিক শিক্ষক সহযোগিতার ভিত্তিতে সমষ্টিগতভাবেও এই গবেষণা পরিচালনা করতে পারেন। কার্যোপযোগী গবেষণার আরেকটি ধারা হলো শিক্ষক এবং বিশেষজ্ঞ-গবেষক সম্মিলিতভাবে শিক্ষা সংক্রান্ত নানাবিধ সমস্যার সমাধান করতে পারেন।

ছোট বা বড় যে কোন বিষয়/সমস্যা, শিক্ষা বা ব্যবস্থাপনা চর্চা/অনুশীলনের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক ক্ষেত্রেই কার্যোপযোগী গবেষণা প্রয়োগ করা যায়। যেমন- বিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, শ্রেণি-ভিত্তিক শিক্ষার্থী মূল্যায়ন, পেশাগত চর্চার বিকাশ ও উন্নয়ন, শিক্ষণ পদ্ধতি, শিখন কৌশল, শিক্ষার্থী মূল্যায়ন, ধারাবাহিক পেশাগত উন্নয়ন, শ্রেণি-শিখন ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক বিষয়, ফলাবর্তন পদ্ধতি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক ইত্যাদি। শিক্ষার্থীদের শিখন-মান উন্নয়নের জন্য একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের অনেক বিষয় নিয়েই গবেষণা করতে পারেন। যেমন- একীভূত শিক্ষণ পদ্ধতির প্রয়োগ, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, মানসম্মত প্রশ্ন প্রণয়ন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা বৃদ্ধি, শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের পাঠগত অবস্থান নির্ধারণকরত স্তরভিত্তিক পাঠদান ইত্যাদি।

‘গবেষণা’ পদটি দ্বারা জ্ঞান অর্জনকে বোঝায় যা অনুসন্ধানীয়-প্রপঞ্চকে ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে সহায়তা করে। আর এই অনুসন্ধানের ফল দ্বারা নিজ পেশাগত চর্চা/অনুশীলনের উন্নয়ন ঘটানো কিংবা বাস্তব/ব্যবহারিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। কাজেই কার্যোপযোগী গবেষণার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দুভাবেই উদ্দেশ্য অর্জিত হয়। প্রথমত, ঘটনা-বিষয়-পরিস্থিতিকে বিস্তারিতভাবে জানা ও বোঝা এবং দ্বিতীয়ত, উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো বা সমস্যার সমাধান করা। প্রচলিত গবেষণার ন্যায় কর্মোন্নয়ন গবেষণার উদ্দেশ্য শুধু নতুন জ্ঞানার্জন নয়, বরং উন্নয়নের পথনির্দেশক হিসেবে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং পরবর্তী সময়ে তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। অন্য কথায়, কার্যোপযোগী গবেষণার উদ্দেশ্য হলো তত্ত্ব (theory) ও চর্চার (practice) সমন্বয় সাধন। শিক্ষায় কার্যোপযোগী গবেষণার একটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো শ্রেণি-শিক্ষককে গবেষকের ভূমিকায় প্রতিষ্ঠা করা যাতে সহকর্মীদের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিজ পেশার ক্রমাগতভাবে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। একজন শিক্ষক তখনই তার শিক্ষার্থীর শিখন-মান নিশ্চিত করতে পারেন যখন তিনি একজন গবেষক এবং প্রতিনিয়ত নিজ কার্যের মূল্যায়ন করেন।

গবেষণার সাধারণ বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি কার্যোপযোগী গবেষণার বেশকিছু ভিন্নতর বৈশিষ্ট্য রয়েছে- যা এর ভূমিকাকে সুস্পষ্টভাবে সমাধানমুখী ও উপকারী করে তোলে। এই জাতীয় অনুসন্ধানের মাধ্যমে কমপক্ষে তিন ধরনের প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়। যেমন, সমস্যা কী ধরনের, সম্ভাব্য কারণ কী, কীভাবে সমস্যার সমাধান সম্ভব। অর্থাৎ, সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধান উভয়ই এ গবেষণার লক্ষ্য। এ গবেষণার দুটি প্রধান ভূমিকা রয়েছে। যেমন- (১) শিক্ষামূলক ভূমিকা (পরিবর্তন এনে বা সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে অনুসন্ধানীয় বিষয় বা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো) (২) সামাজিক ভূমিকা (গবেষণা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের এবং সম্ভাব্য অন্যান্যদের জড়িত করা)। এ দুটি ভূমিকা অন্যান্য গবেষণায় অনুপস্থিত। এ গবেষণা অংশগ্রহণভিত্তিক (participatory); প্রচলিত গবেষণার তথ্য প্রদানকারী এ গবেষণায় সক্রিয় গবেষকের ভূমিকা নেন। যেমন- শ্রেণি-শিক্ষক নিজেই গবেষক হিসেবে কাজ করেন (স্বাধীনভাবে অথবা বিশেষজ্ঞ গবেষকের সহায়তা নিয়ে) এবং নিজ শিক্ষণ-চর্চার উন্নয়ন ঘটান। কার্যোপযোগী গবেষণা সহযোগিতাধর্মী (collaborative); বিশেষজ্ঞ গবেষক, শিক্ষক এবং সহকর্মী যৌথভাবে কাজ করেন। পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে অনুসন্ধান ও সমাধান প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যান। এ গবেষণার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো পরিস্থিতি-কেন্দ্রিকতা (situaitonal); স্থানীয় পরিবেশে সমস্যার প্রকৃতি অনুযায়ী লব্ধ সম্পদ ব্যবহার করে নির্বাচিত বিষয় বা উদ্ভুত সমস্যার সমাধান করা যায়। কার্যোপযোগী গবেষণায় তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে একাধিক পদ্ধতির (যেমন- পর্যবেক্ষণ, সাক্ষাৎকার, নোট, ভিডিও বা অডিও) সমন্বয় সাধন করা হয়। এর ফলে উপাত্তের যথার্থতা বৃদ্ধি পায় এবং উপযুক্ত সমাধানের পরিকল্পনা করা যায় ও বাস্তবায়ন করা যায়। এক্ষেত্রে বহিরাগত বিশেষজ্ঞ-গবেষক সহায়কের (facilitator) ভূমিকা পালন করেন। তার দ্বারা শিক্ষকের ওপর তার মতো বা পরিকল্পনা আরোপ করা বা চাপিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ থাকে না। বরং গবেষণার প্রতিটি ধাপ দু’পক্ষের (যেমন- শিক্ষক ও গবেষক) সংলাপে সংঘঠিত হয়। নমনীয়তা (flexibility) এ গবেষণার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ গবেষণার বিভিন্ন ধাপে উদ্ভূত অবস্থা অনুযায়ী পরিকল্পনা বা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা যায়। কোন বিষয়ে অনড় থাকার অবকাশ নেই। এ গবেষণা বৃত্তীয় এবং সর্পিল (cyclical and spiral); গবেষণার ধাপগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটে। কিন্তু প্রতি পুনরাবৃত্তিতে নতুন সমস্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ঘটানো হয়। এ গবেষণা বিকাশমান: পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও প্রক্রিয়া পাশাপাশি চলে।

কার্যোপযোগী গবেষণা হলো পরিবর্তন এবং মনোন্নয়নের গবেষণা। কাজেই, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে শিখন-শেখানোর মানোন্নয়ন, শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষক যোগ্যতা অর্জন, শ্রেণি শিক্ষণ-শিখন কার্যাবলি ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মিথস্ক্রিয়ার (teacher-student interaction) মানোন্নয়নের জন্য কার্যোপযোগী গবেষণা একটি কার্যকর উপায় হতে পারে।

শিক্ষক হচ্ছেন বিদ্যা ও জ্ঞানদাতা। ঘরে ঘরে জ্ঞানপ্রদীপ প্রজ্জ্বলনে অনন্য ভূমিকা পালনের জন্য সমাজে তারা পূজনীয় ও সম্মানীয়। শিক্ষক হবেন তথ্য ও জ্ঞানেরভান্ডার। তাই তাকে প্রতিনিয়ত অজানাকে জানার দুর্নিবার স্পৃহা নিয়ে জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশ করতে হয়। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য ও অভিজ্ঞতা তার জ্ঞানভান্ডারে সংযোজন করতে হয়। শিক্ষকতা পেশাটাকে জানতে ও বুঝতে হবে। এ পেশার মধ্যে যে নতুনত্ব ও বৈচিত্র্য আছে তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে শিখতে হবে। কোমলমতি শিশুদের ছোট ছোট পরিবর্তন যার মনে দোলা দেয় না, তিনি কখনো প্রকৃত শিক্ষক হতে পারবেন না। আগামী প্রজন্মের চাহিদাকে সামনে রেখে শিক্ষককে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষককে সব সময় বিভিন্ন কার্যোপযোগী গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করে যোগ্যতর শিক্ষক হিসেবে প্রস্তুত করতে হবে। আর অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে। আর নিজেকে যোগ্য শিক্ষক হিসেবে প্রস্তুত করতে না পারলে শিক্ষার্থীরাই এক সময় সে শিক্ষকের প্রতি আকর্ষণ হারাবে। একজন শিক্ষকের জন্য এটি কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না।

লেখক : ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার (ইউআরসি), নেত্রকোনা

 

সৌজন্যে: দৈনিক সংবাদ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0048370361328125