শিক্ষকতার একাল সেকাল ও সরকারিকরণ

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

বেসরকারি স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করা মানুষ আমি। আমার শিক্ষকেরা কুড়ি-পঁচিশ টাকা বেতনে শিক্ষকতা করেছেন। সে কথা তাদের মুখেই শুনেছি। তাদের পেশাদারী মনোভাবটি অন্য রকম ছিল। আশ্চর্য এক দায়বদ্ধতা তাদের মাঝে খুঁজে পেতাম। অন্যের সন্তানকে মানুষ করার অদম্য প্রয়াস ছিল। পেশা ছাড়া অন্য কোন চিন্তা ছিল না। পেশাই ছিল ধ্যান-জ্ঞান আর নেশা। তাদের নীতি ও আদর্শ সব কিছুর ঊর্ধে ছিল। বই-পুস্তকে সর্বদা ডুবে থাকতেন। জানার পরিধি বাড়ানোর এক অনমনীয় নেশায় ব্যস্ত থাকতেন। ছাত্রের মাঝে নিজের জ্ঞানটুকু ছড়িয়ে দিতে কত না আন্তরিক ছিলেন।

একেকজন পণ্ডিতসম ব্যক্তি ছিলেন কিন্তু পণ্ডিতম্মন্য ছিলেন না। আজকাল এমন শিক্ষক খুব কমই পাওয়া যায়। এখন দিনে দিনে শিক্ষককে নানা দুর্নামে পেয়ে বসেছে। নোট গাইডের বদনাম। কোচিং বাণিজ্যের বদনাম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বদনাম। প্রশ্নফাঁসের বদনাম। বই-পুস্তকের সাথে অনেক শিক্ষকের কোন সখ্যতা নেই। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটুকু পড়ে এসেছেন তা দিয়েই শিক্ষকতা চালিয়ে নিতে চান। খুব কম শিক্ষক পাওয়া যায় যারা বই পুস্তকে লেগে থাকেন। 

আমার শিক্ষকেরা গ্রন্থকীট ছিলেন। ঢালাওভাবে সকল শিক্ষকের কথা বলি না। দু' চারজন শিক্ষকের কারণে গোটা শিক্ষক সমাজের অনেক বদনাম। এসব দুর্নাম থেকে শিক্ষক সমাজকে রক্ষা করতে না পারলে শিক্ষা ও শিক্ষক উভয়ের জন্য দুর্দিন অপেক্ষা করছে। এমনিতে শিক্ষার বেহাল দশা। সাধারণ লোকজন পর্যন্ত শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নিয়ে আজে বাজে মন্তব্য করতে মোটেও চিন্তা করে না। মাত্র দুই যুগ আগেও এমনটি ছিল না। ছোটবেলায় দেখেছি, শিক্ষকদের কত সম্মান। লোকজন তাদের মাথায় তুলে রাখত। কোন কিছু হলেই শলা-পরামর্শ ও বুদ্ধির জন্য শিক্ষকের কাছে ছুটে যেত। শিক্ষকের হাতে সন্তান সঁপে দিয়ে বাবা-মা নিশ্চিন্ত প্রশান্তির মাঝে ডুবে থাকত। ছাত্রদেরও মানুষ সমীহ আর স্নেহ দু'টোই করত। এখন অবস্থা অনেকটা বিপরীত। সমাজে শিক্ষকের কদর আগের মত নেই। শিক্ষকের প্রতি এখন অনেকেরই তীর্যক দৃষ্টি ও হীন মনোভাব। শিক্ষকের মর্যাদা যেটুকু বাকি তা কেবল মুখে আর বই পুস্তকে। কবি কাদের নেওয়াজের 'শিক্ষকের মর্যাদা 'কবিতাটি আজকাল শিক্ষকের সম্মানের বিষয়ে একটি দৃষ্টান্ত মাত্র।  
     
আজকাল ছাত্ররা শিক্ষককে ভয় করে না। খুব কমই সমীহ করে। আমরা আমাদের শিক্ষকদের বাঘের মত ভয় করেছি। আজও যারা বেঁচে আছেন তাদের সামনে গেলে ছোটবেলার ছোট্ট শিশুটির মত হয়ে যাই। ভয়ে বুক ধড়ফড় করে। সামনে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে দু'-চার কথা বলতে সাহস পাই না।   ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধুর যুগের স্বপ্নের সোনালি দিনগুলো আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। প্রত্যেক শিক্ষক ছিলেন একেকজন মডেল। এখন সরকার জায়গায় জায়গায় মডেল স্কুল করে দিচ্ছে। কিন্তু মডেল শিক্ষক খুঁজে পাওয়া কঠিন। মডেল শিক্ষক তৈরির কোন উদ্যোগ নেই। রাষ্ট্র ও সরকারের এ বিষয়ে দায় এড়াবার কোন সুযোগ নেই। ছাত্রদের এক আধটু শাসন করার অধিকার শিক্ষকের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। এর ফলে শিক্ষককে ছাত্রের ভয় নেই। উল্টো এখন ছাত্রকে শিক্ষকের ভয়। এটি শিক্ষার জন্য কত যে ক্ষতিকর একটি কাজ হয়েছে, সে আমাদের এখনই ভেবে দেখা দরকার। আরেকটি বিষয় শিক্ষকদের মান-মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী। সেটি একই স্তরের শিক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি বিভাজন। বেসরকারি শিক্ষকগণ নানা ভাবে হয়রানি ও বঞ্চনার শিকার। পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু ভালভাবে বেঁচে থাকার গ্যারান্টি নেই বলে তাদের হতাশা চরম।

এ প্রজন্মের মেধাবীরা তাই বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষকতায় আসতেই চায় না। এ অনীহা গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য হুমকি ও ঝুঁকির বিষয় বটে।  সাম্প্রতিক বছর গুলোতে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের কপাল কিছুটা হলেও ফিরতে শুরু করেছে। আমার শিক্ষকরা যেখানে কুড়ি-পঁচিশ টাকা বেতন পেতেন, সে জায়গায় আজকাল শিক্ষকরা কুড়ি-পঁচিশ হাজার টাকা পান। আগে তারা যেখানে শুধু ছাতা, লাঠি আর পাঞ্জাবি নিয়ে বিদায় নিতেন, আজ সেখানে কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা দু'টো মিলে অন্তত আট দশ লাখ টাকার একটা ব্যবস্থা তো আছেই। বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতার নামে একটু হলেও কিছুটা তো দেয়া হয়। সরকার ইদানিং সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণে অনেকটাই আন্তরিক বলে মনে হয়।

অতি সম্প্রতি বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য মূল বেতনের পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও বিশ শতাংশ বৈশাখী ভাতা প্রদানের ঘোষণার মধ্যে সে সদিচ্ছাটিই প্রতিফলিত হয়েছে। আমি খুব আশ্বস্ত হয়েছি সরকারি একটি আদেশে ইনক্রিমেন্টের ক্ষেত্রে 'সরকারি স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীর ন্যায়' কথাটি উল্লেখ থাকায়। আরেকটি ধোঁয়াশা ছিল, ইনক্রিমেন্টটি বছর বছর হবে নাকি একবার হবে। এ নিয়ে সারা দেশের বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর প্রশ্নের শেষ ছিল না। সে ধোঁয়াশা আর অমানিশার ঘোর তখনি কেটে যায়, যখন লাখ লাখ শিক্ষকের প্রাণপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক শিক্ষায় সরকারি আদেশে ইনক্রিমেন্ট কার্যকরের তারিখ ১ জুলাই-২০১৮ এবং পরবর্তী বেতন বৃদ্ধির তারিখ ২০১৯ সালের ১ জুলাই  উল্লেখ সুস্পষ্টভাবে লেখা দেখি। তাছাড়া সময়ের পরিক্রমায় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীগণ যেটুকু আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন, সেটি একেবারে যথেষ্ট নয়।আমি শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধার কথা লিখতে গেলে কেউ কেউ বিরূপ মন্তব্য করেন। তারা বলেন-শিক্ষকদের কত মান সম্মান! তাদের আবার এত টাকা পয়সার কী এমন দরকার? এ সব লোকদের সবিনয়ে বলি, শিক্ষকদেরও পেট-পিঠ আছে। বাচ্চা-কাচ্চা ও পরিবার-পরিজন আছে। তাদেরও খেতে হয়। খেয়ে পরে বাঁচতে হয়। বাড়ি ঘর লাগে। বাড়ি ভাড়া দিতে হয়। রোগে শোকে ভোগে ডাক্তারে যাওয়া লাগে। ওষুধপত্র খেতে হয়। সালাম আর সম্মানে তৃপ্তি আছে বটে কিন্তু এগুলো টাকা যোগান দেয় না। দিতে পারে না। সকলের জানা কথা, 'ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়'। এ প্রসঙ্গে মুসলিম মনীষী ইবনে খলদুনের একটি কথা মনে পড়ে যায়। তিনি তার 'আল মুকাদ্দিমা' গ্রন্থে বলেন-'শিক্ষকও একজন মানুষ। সমাজের আর দশজন মানুষের মত শিক্ষকের ও ব্যক্তিগত জীবনে বেঁচে থাকার উপকরণের প্রয়োজন আছে'। 

ইবনে খলদুন যে সময়ের কথাটি বলেছেন, সে সময় ও আজকের সময়ে আকাশ-পাতাল তফাত। সেকাল ও একালের জীবন যাত্রায় দিন-রাত ব্যবধান। ইবনে খলদুনের কথাটি বর্তমান সময়ের শিক্ষকদের বেলায় শতভাবে সহস্রগুণ বেশি প্রযোজ্য একটি খাঁটি কথা। তাই শিক্ষকদের কথা আলাদা করে ভাবতে হবে। শিক্ষকের জীবন মান উন্নত হলে শিক্ষার মান আস্তে আস্তে আগের জায়গায় ফিরে আসবে। 

এ বিষয়ে তর্কের কোন অবকাশ আছে বলে অন্তত আমার মনে  হয় না। ইদানিং মনে হয় সরকার এই নিরেট সত্য কথাটি উপলব্ধি করে সে পথেই হাঁটতে শুরু করেছে। বেসরকারি শিক্ষকদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতা প্রদান তাদের চাকরি সরকারিকরণের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।দেশের বেসরকারি স্কুল-কলেজ সরকারিকরণের বিষয়টি এখন এক টার্নিং পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। সে সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে ভাগ্যাহত বেসরকারি শিক্ষক সমাজের মুখে অনাবিল হাসি ফুটিয়ে তুলতে হবে। তাহলে আমাদের শিক্ষায় ঘটে যাবে এক অনন্য যুগান্তকারী বিপ্লব। দেশ এবং জাতিকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে শিক্ষকদের ও ঘুরে দাঁড়াতে হবে। কিছু পেতে হলে আরো বেশি কিছু দিতে হয়-সে কথাটি বিস্মৃত হলে চলবে না।                                                        

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028908252716064