শিক্ষকদের অন্ধকারে রেখে দেড় লাখ কোটি টাকার প্রকল্প!

নিজস্ব প্রতিবেদক |

পাঁচ তারকা হোটেলে কোটি টাকা খরচ করে সূচনা অনুষ্ঠান হয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় প্রোগ্রাম স্টিয়ারিং কমিটির চেয়ারপারর্সন ও কো-চেয়ারপাসন ঠিক করা হয়েছে। প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর ও সহযোগীও নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়নের জন্য এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প সম্পর্কে কিছুই জানেন না মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনের অধিকাংশ কর্মকর্তা। প্রকল্পদলিলের কপি দেখেননি একটি বিশেষ গোষ্ঠী ছাড়া অন্য কেউ। প্রকল্প ব্যয় সম্পর্কে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিকল্পনা শাখার কর্মকর্তারা শুধু বিলিয়ন ডলারের হিসেব বলেন। বাঙালি-বাংলাদেশি হয়েও তারা টাকার হিসেব বলতে চান না। জানা যায়, এক শ্রেণির আমলার দূরভিসন্ধিমূলক মনোভাব থেকেই টাকার হিসেব চাউর না করে বিলিয়ন ডলারের হিসেব চালিয়ে যেতে চান। 

মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় পাঁচ বছর মেয়াদী (২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২) ‘মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প’ এসইডিপি এর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। প্রাথমিকভাবে এর ৯৫ ভাগ অর্থ দেবে সরকার। আর মাত্র ৫ শতাংশ আসবে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, ইউনিসেফ ও ইউনেস্কোসহ মোট ছয়টি সংস্থার কাছ থেকে। শর্তানুসারে প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট হলে এসব সংস্থা প্রকল্পে ভূতাপেক্ষভাবে ঋণ দেবে। 

অথচ বিশাল এই প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পাননি মাধ্যমিকের কোনও শিক্ষক অথবা শিক্ষা প্রশাসনের কর্তারা। এমনকি সূচনা অনুষ্ঠানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় সরকারের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (রুটিন দায়িত্ব) আসন হয়নি মঞ্চে। তাঁকে বসতে দেয়া হয়েছে দর্শক সারিতে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইনের সভাপতিত্বে প্রকল্পের সূচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। বক্তব্য রাখেন কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর, বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর সঞ্জয় শ্রীবাস্তব, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন পারকাশ এবং বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব বিএনপিপন্থী কর্মকর্তা হিসেবে শিক্ষাখাতে পরিচিত ড. মো. মাহামুদ উল হক প্রোগ্রাম সম্পর্কে পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করেন। 

সাধারণ স্কুল-কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরির তিনটি পৃথক অধিদপ্তর ও এর অধীনস্ত প্রকল্পসমূহে কর্মরত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এবিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। অনেকে জানতে চেয়েও জানতে পারছেন না। সরকারি-বেসরকারি পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষকদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন। কোনও সংগঠনের কোনও নেতাকেই কিছুই জানানো হয়নি। শিক্ষা বিষয়ক সাংবাদিকদের একমাত্র সংগঠন এডুকেশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ইরাব) এর ৪০ সদস্যের কেউ কিছু জানেন না এই প্রকল্প সম্পর্কে।অধূনা বিলুপ্ত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারা দাবি করেছেন তারা কিছু জানেন না্। তবে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সমিতির জুনিয়র কয়েকজন  সদস্য দৈনিক শিক্ষাকে জানান তারা ছয়মাস আগেই সমিতির মহাসচিবসহ অন্যান্য নেতাদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন নতুন এই প্রকল্পে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের ভূমিকা ও অংশগ্রহণ সম্পর্কে জানতে কিন্তু তারা তা করেননি। সমিতির পদ ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছানোর কাজেই ব্যস্ত তারা। 

জানা যায়, ৩১ অক্টোবর প্রকল্পের সূচনা অনুষ্ঠানের পর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে জোরেশোরে। গত বুধবার (৭ নভেম্বর) এই প্রকল্প দলিল সম্পর্কে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (ফিন্যান্স ও প্রকিউরমেন্ট) অধ্যাপক মো: মোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, সেসিপে অনুষ্ঠিত আজকের সভায় প্রকল্প দলিল বিষয়ে কথা হয়েছে। আমাদেরকে শুধু খসড়ার একটি কপি দেয়া হয়েছে। তবে বলে দেয়া হয়েছে, এটি সাংবাদিকদের দেখানো যাবে না। চূড়ান্ত হওয়ার পরে সবাইকে দেয়া যাবে।

একাধিক সূত্র দৈনিক শিক্ষাকে জানায়, এই প্রকল্পের মূল পদগুলোতে যারা রয়েছেন তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সামান্যতম যোগাযোগ নেই। মাসিক ১৬ লাখ টাকা বেতন দিয়ে বিদেশী পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ডেপুটেশন ও লিয়েনে বিএনপিপন্থী কয়েকজন অতিরিক্ত সচিব নিয়োগ পাওয়ার সব ব্যবস্থা চূড়ান্ত করা হয়েছে।

শিক্ষা ভবনে কর্মরত একজন প্রভাষক দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, দেড়লাখ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি বর্তমান ডিজাইন অনুযায়ী বাস্তবায়ন হলে শিক্ষা ক্যাডারের আর কোনও কার্যকরিতা থাকবে না। এই প্রকল্পকে ‘শিক্ষা ক্যাডারের জম’ হিসেবে অভিহিত করা যায়।   

উল্লেখ্য, এর আগে বিএনপি-জামাত জমানায় সেসিপ নামের একটি প্রকল্প থেকে একমূখী শিক্ষা,বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্যায়ন ও কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন চালু করার জন্য ৫৯৩ কোটি টাকা ঋণ করে লুটপাট করা হয়। ওই প্রকল্পের প্রধান ছিলেন বশিরুল হক নামের প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা।

জানা যায়, ওই প্রকল্পের পরামর্শক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের জামাতপন্থী শিক্ষক অধ্যাপক ইকবাল আজিজ মোত্তাকি ও ৩০ বছর যাবত শিক্ষার সব প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে থাকার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একই বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মো: সিদ্দিকুর রহমানসহ কয়েকজন।  


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোজায় স্কুল: শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম, নজরদারিও ঢিলেঢালা - dainik shiksha রোজায় স্কুল: শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম, নজরদারিও ঢিলেঢালা পেনশন প্রজ্ঞাপনে উদ্বিগ্ন ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha পেনশন প্রজ্ঞাপনে উদ্বিগ্ন ঢাবি উপাচার্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুদান করমুক্ত - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুদান করমুক্ত ব্রাজিলে তীব্র গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ - dainik shiksha ব্রাজিলে তীব্র গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের নামে প্রতারণা, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের নামে প্রতারণা, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পেলো ‘হেট’ - dainik shiksha উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পেলো ‘হেট’ আটকের ১৩ দিন পরেও বরখাস্ত হননি অধ্যক্ষ - dainik shiksha আটকের ১৩ দিন পরেও বরখাস্ত হননি অধ্যক্ষ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0054428577423096