শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে প্রতারণা

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রাথমিক শিক্ষক সমাবেশ যা অনেকটা ৮১ মহাবিক্ষোভকে মনে করে দিতে চেয়েছিল। নেতৃবৃন্দের অনৈক্য ও সরকারের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী সংশ্লিষ্টরা সমাবেশ করতে বাধা প্রদান করে প্রাথমিক শিক্ষকদের সাথে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। 

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ঊষালগ্নে চরম অভাবের মাঝে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের জাতীয়করণ করে, ভালবাসার উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সকল বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। এছাড়াও শিক্ষার উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশ বিদেশে শিক্ষাবান্ধব সরকার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। শিক্ষাবান্ধব সরকারের অনেক অর্জনের পরও প্রাথমিক শিক্ষকেরা নির্মম যন্ত্রণায় অস্থির। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। তিনি আজীবন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। বৈষম্য নিরসন না করায়, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সংগ্রামী ইতিহাস জানার মাধ্যমে বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম জানতে পারবে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের শিক্ষকেরা বৈষম্য দূরীকরণে সংগ্রামে অনুপ্রেরণা লাভ করবে। দীর্ঘ ১ যুগ এ প্রজন্মের নেতৃবৃন্দ প্রাথমিক শিক্ষায় বঙ্গবন্ধুর অবদান ও বৈষম্য দূরীকরণে তাঁর সংগ্রাম সম্পর্কে না জেনে এসেছে। তারা শুধু অজানা আলোর পিছনে ছুটছে। এর বিনিময়ে তারা জানতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ইতিহাস। নিজস্ব আলোয় উজ্জীবিত না হয়ে দীর্ঘসময় পরেও না হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষার বৈষম্য দূর, না পেয়েছে বৈষম্য দূর করার একমাত্র কর্ণধার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতকার। নিজেদের আলোতে দীক্ষা লাভ না করে অন্যের আলোতে পথ চলা নিছক মূর্খতা ছাড়া কিছুই না। এ দীর্ঘসময় প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনগুলো নিজস্ব আলোতে পথ না চলে হয়েছে খন্ড  -বিখন্ড । এ প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক শিক্ষায় বঙ্গবন্ধুর অবদান জানা ও তাঁর জীবন আদর্শ সংগ্রামকে ধারণ করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ গঠন করা হয়েছে । এ পরিষদ প্রাথমিক শিক্ষকদের ঐক্য ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পরিপন্থী কর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিশ্বাসী।

প্রাথমিক শিক্ষায় চরম বৈষম্য। এ বৈষম্য দূর না করার জন্য সর্বাগ্রে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায় উপলব্ধি করছি। বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক শিক্ষা আজ অস্তিত্ব সংকটে। সংকট উত্তরণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে প্রাথমিক শিক্ষকদের ঘাড়ে দোষ তুলে দেওয়া হচ্ছে। যেমন শিক্ষার্থী কম কেন ? পাঠে দুর্বল কেন ? বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী অনুপস্থিত কেন ? শুধু হৈ চৈ এর মাঝে সীমাবদ্ধ তাদের কর্মকা-। কেন প্রশ্নের জবাব শুধু যত দোষ নন্দ ঘোষের প্রবাদের মত। দীর্ঘসময় বিদ্যালয়ে শিক্ষক শূন্য, শিক্ষকদের নানা কাজে টানাটানি। ভাবখানা এমন যে, অভিভাবকেরা সংশ্লিষ্টদের ক্রীতদাস, তাদের সন্তানদের কর্মজীবীদের মত সকাল ৯টা থেকে ৪.৩০টা পর্যন্ত বিদ্যালয়ে অবস্থান করাবে। আর কিন্ডারগার্টেন স্কুল ৮-১২ টা পর্যন্ত চলবে।

একদিকে কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ের ব্যবসায়ীক মনোবৃত্তি ও প্রসারে সুযোগ দেবেন আর অন্যদিকে অভিন্ন (পাঠ্যবই, সময়সূচি) শিক্ষক সংকট ও শিক্ষকদের নানা কাজে ব্যস্ত রেখে মায়া কান্না, দরদ, প্রাথমিক শিক্ষায় ভালবাসার নামে প্রতারণা করা হবে। বিষয়টি কাম্য নয়। অপরদিকে চাপাবাজির কষাঘাতে চলছে প্রাথমিক শিক্ষকেরা। সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি বৈষম্য সৃষ্টি করে চলেছে শিক্ষক নেতারা। প্রাথমিক শিক্ষকদের ঐক্য পরিষদ, মহাজোট, প্রধান শিক্ষকদের ২টি সংগঠন, পুল, প্যানেল, মা শিক্ষক সংগঠন নামে ৩টি সহ সহকারিদের অসংখ্য চাপাবাজ সংগঠনের মাঝে অবস্থান করছেন প্রাথমিকের শিক্ষক সমাজ। অস্তিত্ববিহীন নেতা সর্বস্ব সংগঠন যাদের শুধু সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক ছাড়া কেউ নেই। তারাও চাপার জোরে মঞ্চে শরীক সংগঠন হিসেবে ঐক্য পরিষদ বা মহাজোটে অবস্থান করছে।

শহীদ মিনারে মহাজোট আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ায় ‘প্রাথমিকে মহাজোট নেই কেন ততো চোট’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছিলাম। অতি দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে বলতে হচ্ছে প্রাথমিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নিয়ে কোন সংগঠন আছে বলে দৃশ্যমান নয়। তাদের আদর্শ যখন যে কর্মকর্তা, মন্ত্রী থাকবে তখন তাদের সেবায় মশগুল থাকা। তাদের শিক্ষা বা শিক্ষকদের সমস্যা নিয়ে প্রতিবাদের ভাষায় কথা বলার তেমন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া দুঃস্কর। প্রাথমিকের সহকারিদের ১২তম গ্রেডের প্রস্তাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করার সময় জেনে শুনে প্রাথমিকের আজকের ঐক্য পরিষদ, মহাজোট কারো মাঝে প্রতিবাদের সুর দেখা যায়নি। আজ যখন সাধারণ শিক্ষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ ও প্রতিবাদী হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন নেতৃবৃন্দের ১১তম গ্রেড নিয়ে মায়াকান্না। নেতৃবৃন্দের কতটুকু আন্তরিক তা সময়ই বলে দিবে।

আমার বদ্ধমূল ধারনা নেতৃবৃন্দ নেতৃত্ব করছেন, তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য। তা না হলে ঐক্য পরিষদ ২৩ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ডেকেছে। অথচ পূর্বের কর্মসূচি বাতিল করে মহাজোট ২৩ অক্টোবর বিভাগীয় সমাবেশ কেন ডেকেছে ? শিক্ষকদের বিভিন্ন সভায় যোগদান করে যা আমার কাছে প্রতীয়মান হলো নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বের মোহ থেকে এখনো বের হতে পারেনি। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন “আন্দোলন গাছের ফল নয়, আন্দোলন মুখ দিয়ে বললেই করা যায় না। আন্দোলনের জন্য জনমত সৃষ্টি করতে হয়। আন্দোলনে নিঃস্বার্থ কর্মী থাকতে হয়। ত্যাগী মানুষ থাকা দরকার। আর সর্বোপরী জনগণের সংঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ সমর্থন থাকা দরকার।”

প্রাথমিকের শিক্ষক সমাজ আজ ঐক্যবদ্ধ। নেতৃবৃন্দের অনৈক্য ১১তম গ্রেড প্রাপ্তির প্রধান চ্যালেঞ্জ, প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। এ মুহুর্তে সচিব, প্রতিমন্ত্রীর নীরবতা অনেকটা বুয়েটের ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তাদের নিঃস্তব্ধতা কখন ভাঙবে জানি না। প্রায় চার লক্ষ শিক্ষকের প্রতিটি শিক্ষকের মনে ১ দফা দাবি আদায়ের আগুন জ¦লছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের সুযোগ না পেলে জরুরী বার্তা পাঠান। শিক্ষকদের কাছে আপনাদের প্রদত্ত অঙ্গীকার থেকে দায়মুক্ত হোন। অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রতীক্ষায় বসে থাকা শুধু সময়ক্ষেপন ছাড়া কিছুই না। এ শুধু প্রাথমিক শিক্ষকদের সাথে ভালবাসার নামে নির্মম প্রতারণা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে প্রাথমিক শিক্ষা এগিয়ে নিতে কার্যকর ব্যবস্থা নিন। একটি প্রবাদ আছে ‘মন ভাঙ্গা আর মসজিদ ভাঙ্গা’ ভিন্ন নয়। প্রাথমিক শিক্ষকদের মনে অশান্তি থাকলে কোন ফলপ্রসু উদ্যোগ সফল হবে না। প্রাথমিক শিক্ষকদের ১ দফা দাবি বাস্তবায়ন হলে বঙ্গবন্ধুর বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম হবে। পাশাপাশি পূরণ হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন। জয় বাংলা, জয় হোক শিক্ষকদের।

মো. সিদ্দিকুর রহমান : সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.014191150665283