বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলি ও বাড়ি ভাড়া নিয়ে আগেও লিখেছি। আজ কয়দিন থেকে এ নিয়ে দৈনিক শিক্ষায় আবার কিছু লেখার জন্য কেন জানি ভেতরে ভেতরে তাগিদ অনুভব করছি। অনেক শিক্ষক বন্ধুও ইদানিং এ বিষয়ে লেখার অনুরোধ জানিয়ে আসছেন। কেউ ফোনে কেউ বা মেইলে। বিবেকের তাড়না ও অনুরোধে আজকের এ প্রয়াস। কিন্তু যাদের হাতে শিক্ষার কলকাঠি, তাদের বিবেকে এতটুকু নাড়া না দেবার কারণ খুঁজে পাই না। তাদের বিবেক কোথায়, কার কাছে অবরুদ্ধ থাকে? নাকি বিবেক বিবর্জিত মানুষগুলোই শিক্ষার কর্ণধার হয়? এটি আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষকদের জন্য দূর্ভাগ্যের বিষয়।
আমাদের দেশে শিক্ষার মান নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। কিন্তু শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষকের জীবন মান সর্বাগ্রে নিশ্চিত করা অপরিহার্য-সে কথাটি অনেকে জেনে শুনেও মুখে উচ্চারণ করেন না। হাজার কোটি টাকা দালান, বিল্ডিং তৈরীতে খরছ হয়। লেট্রিন নির্মাণে শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। একদল আছেন তারা কেবল অবকাঠামো উন্নয়নের দোহাই দেন। তাদের অন্য একটা মতলব আছে। মতলবটি এই-অবকাঠামো নির্মাণে বিভিন্ন পর্যায়ে টু পাইস কামানোর সুযোগ থাকে। সহজে দূর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া যায়। অবকাঠামোর বিষয়টি একদম অস্বীকার করিনা। কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়নে এটি একমাত্র কিংবা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। শিক্ষকদের জীবন মান না বাড়িয়ে কেবল অবকাঠামোর উন্নয়ন দিয়ে শিক্ষার উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করা কোনমতে সম্ভব নয়। দালান-বিল্ডিং এমনকি রাজ প্রাসাদের ভেতরও উপোস কোন মানুষ বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারেনা। খেয়েদেয়ে ছনের চালাঘরেও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা যায়।
আবার বাংলাদেশের শিক্ষার উন্নয়নের নামে বিদেশ থেকে হাজার কোটি টাকা এনে যুগ যুগ ধরে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে চলছে শিক্ষা বিষয়ক শত শত এনজিও। তাদের গবেষণায় বলা হচ্ছে অমুক কারণে শিক্ষকরা শিক্ষকতা পেশায় এসেছে ইত্যাদি। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে কাজ করার নামে বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা আনা এই এনজিওগুলো কখনোই বলছে না তাদের চেষ্টায় শিক্ষার কতটুকু উন্নতি হয়েছে। ঘুরেফিরে তাদের প্রতিবেদনে শিক্ষকদের সম্পর্কে নেতিবাচক দিকটিই তুলে আনা ও ঘটা করে প্রকাশ করা হয়। তাদের কোনও প্রতিবেদনে বলা হয় না শিক্ষকরা এইএই ভাবে বঞ্চিত, তাদের জন্য সরকার কেন এটা করছে না? এমন শক্ত প্রশ্ন তুলতে দেখি না শিক্ষকদের পক্ষে।
শিক্ষকতা যে কত কঠিন কাজ-সে বিষয়টি অন্য অনেকে উপলব্ধি করতে পারেনা। ইদানিং গবেষণায় একটি বিষয় উঠে এসেছে। সেটি এই- অন্য যে কোন পেশা অপেক্ষা শিক্ষকতায় সবচেয়ে বেশি মানসিক চাপ। আমাদের দেশে শিক্ষকদের সেই চাপটি আরো বেশি। শিশুদের টীকা খাওয়ানো থেকে শুরু করে নানান কাজে শিক্ষকদের সম্পৃক্ত করা হয়।বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের দায় দায়িত্বের কোন সীমা পরিসীমা নেই। তাদের অনেক কর্তৃপক্ষ। সবার হুকুম মেনে চলা লাগে। আমাদের দেশে যে যাই বলুন না কেন, বেসরকারি শিক্ষকরাই সমাজে এখন সবচেয়ে অবহেলিত মানুষ। মুখ রক্ষার্থে অনেকে সালাম-কালাম দেয় বটে। কিন্তু মনে মনে প্রায় সকলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভেবে থাকে। এ অবস্থার অবসান না ঘটলে শিক্ষার মানোন্নয়ন একেবারে অসম্ভব।
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীগণ তাদের অনেকগুলো মৌলিক অধিকার থেকে নির্মমভাবে বঞ্চিত আছেন। ইদানিং এদের মধ্যে বদলির বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। এ নিয়ে শিক্ষকরা বিভিন্নভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। বিশেষ করে এনটিআরসিএ কর্তৃক গত নিয়োগটি সম্পন্ন হবার পর বদলির বিষয়টি একান্ত এক মানবিক দাবিতে রূপান্তরিত হয়েছে। উক্ত নিয়োগে বেশিরভাগ শিক্ষক উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে এবং পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। বেশিরভাগ শিক্ষক ছুটিতে বাড়ি যেতে ও আসতে বেতনের টাকা প্রায় শেষ হয়ে যায়। ছোটখাটো ছুটি ভোগ করতে পারেন না। রোগে শোকে স্বজনের পাশে যেতে পারেন না। প্রিয়জনের শেষ দেখা অনেকের নসিবে জুটেনা। শিক্ষকতার প্রতি তখন অনেকের অনীহা জন্মে যায়।
আমাদের দেশে শিক্ষকতা পেশাটিকে আকর্ষণীয় করার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই কেন? যে কোনও দেশে শিক্ষকরাই উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি-সে সত্যটি সকলকে উপলব্ধি করতে হবে। আমাদের প্রতিবেশী ভূটান সে সত্যটি অনুধাবন করে তাদের দেশে একটি নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণ করেছে। নতুন বেতন কাঠামোয় চিকিৎসক ও মেডিক্যাল কর্মকর্তাদের সাথে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ৫ জুন দেশটির মন্ত্রিসভা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ভূটানের অনলাইন সংবাদ মাধ্যম 'দ্য ভূটানিজ’ এ তথ্যটি জানিয়েছে। ভূটানের প্রধানমন্ত্রির কার্যালয় থেকে দেয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-'নতুন বেতন কাঠামোর এই সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে শিক্ষকরাই হবেন দেশের সর্বোচ্চ বেতন পাওয়া মানুষ।'
আগে কমিটির লোকজন বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়ে থাকতো। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষক নিজের এলাকায় নিয়োগ পেতেন। নিজের বাড়িতে থেকে কোনমতে দু'মুঠো খেয়ে তারা দিন যাপন করতে পারতেন। এনটিআরসিএ কর্তৃক গত নিয়োগ সুপারিশে প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষক ভিন্ন জেলায় নিয়োগ পেয়েছেন। তারা এখন কার বাড়ি থাকবেন? কার বাড়ি খাবেন? বেতনের প্রায় পুরো টাকা নিজের থাকা খাওয়ায় শেষ হয়ে যায়। পরিবার পরিজন বাঁচাবেন কী করে? এভাবে অনেক প্রশ্নবোধক চিহ্নের ভেতর আটকা পড়ে যায় বেসরকারি শিক্ষকের জীবন।
ভূটানের মত দেশ যদি শিক্ষকদের দেশের সর্বোচ্চ বেতন পাওয়া মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নিতে পারে, তবে আমরা পারিনা কেন? এক এক করে দ্রুত সরকারিকরণের দিকে অগ্রসর হোন। বদলির জন্য একটি নীতিমালা হচ্ছে বলে শুনেছি। অবিলম্বে সেটি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দিকে বেসরকারি শিক্ষকগণ তাকিয়ে আছেন। সে সাথে যৌক্তিক বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করে দিন।
অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।