শিক্ষকদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সতেরো শ’ ছিয়াত্তর সালে প্রকাশিত ‘দ্য ওয়েলথ অব নেশনস’ বইয়ে অর্থনীতিবিদ এ্যাডাম স্মিথ জাতির সম্পদ বাড়ানোর তত্ত্ব হাজির করেন। যার সারসংক্ষেপ এরকম-বাজার ও এ সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের নাক গলানো কমাতে হবে। বাণিজ্য হবে অবাধ, মুক্ত, কোন শুল্ক থাকবে না। বাজারের ওপর সরকারের হাত বা নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে নিচু পর্যায়ে নিতে হবে। ‘বাজারের অদৃশ্য হাত’ সব ঠিক করে দেবে। তিনি পথিকৃৎ, পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও উদারবাদের জনক। তাই প্রথমে তার প্রসঙ্গ এলো। তার দেখানো পথে হেঁটে উদারবাদ পৌঁছেছে নয়া উদারবাদের হাটে। আমরা বাস করছি নয়া উদারবাদী দুনিয়ায়। যার মূল সত্য বাজার। বাজারের ওপর কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ রাখা যাবে না। বাজারই শাসক, রাষ্ট্রের কোন নিয়ন্ত্রণ সেখানে থাকবে না। অনিয়ন্ত্রিত মুক্তবাজার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর শ্রেষ্ঠ পথ। সমষ্টি বা জনকল্যাণের ধারণা ত্যাগ করে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সব কিছু ছাড়তে হবে ব্যক্তি মালিকানায়। ব্যাংক, শিল্প-কারখানা, রেল, হাইওয়ে, এমন কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালও। মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, এর অর্থ গরিব মানুষকে তার পরিবারের স্বাস্থ্য, সন্তানের শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষার দায় নিজেদেরই নিতে হবে। রাষ্ট্রের কোন দায় থাকবে না। ওদিকে সব কিছু ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেয়ায় জাতীয় সম্পদ অল্প কিছু সুবিধাভোগীর হাতে জমা হবে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত, শিক্ষাব্যবস্থা এখন এই বাজারের স্রোতে হাবুডুবু খাচ্ছে। নয়া উদারবাদী তত্ত্ব বাস্তবায়নের মূল এজেন্ট হচ্ছে বিশ্বব্যাংক এবং আই এম এফ। তৃতীয় বিশ্বে ‘উচ্চ শিক্ষা সংস্কারে’ প্রতিষ্ঠান দুটো বহু বছর ধরে ‘কাজ’ করছে। যাদের মূল সুর প্রাইভেটাইজেশন, ডিরেগুলেশন এবং মার্কেটাইজেশন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দু’হাজার পাঁচ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য যে পরিকল্পনা পেশ করেছিল তার জোগানদার ছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিশেষজ্ঞসহ বুদ্ধিজীবী মহল বা সিভিল সোসাইটির কেউ জোরগলায় এ প্রশ্ন তোলেননি যে, একটি দেশের উচ্চশিক্ষা বিষয়ক পরামর্শ ও পরিকল্পনা বিশ্বব্যাংক দেবে কেন? সারা পৃথিবীতে গুণে-মানে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বহু গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে। শিক্ষাবিষয়ক পরিকল্পনা তাদের কাছ থেকে নেয়াই স্বাভাবিক ছিল।

তা না করে বিশ্বব্যাংকের মতো একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ফ্যাক্টরি, অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনায় উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রিত হবে কেন? প্রশ্ন তোলেননি, কারণ যারা প্রশ্ন তুললে মিডিয়ায় ঝড় ওঠে তাদের মগজের দখল বিশ্বব্যাংক আগেই নিয়ে নিয়েছে। সুতরাং যা হওয়ার তাই হয়েছে। পরিকল্পনায় মুনাফার প্রতি যতবেশি লোভ জাগানো হয়েছে শিক্ষার প্রতি তত কম আগ্রহ জাগানোর চেষ্টা রয়েছে। পুরো পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে বাজারকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ সেই নয়া উদারবাদের গ্রাস। বিশ্বব্যাংকের পরিকল্পনায় শিক্ষকের স্কিল বাড়ানোর প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। যাতে তিনি তার গ্রাহক শিক্ষার্থীকে বাজারের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারেন। উচ্চশিক্ষার অন্যতম অনুষঙ্গ গবেষণা বা জ্ঞানার্জনের প্রতি কোন গুরুত্ব নেই, না শিক্ষকের না ছাত্রের। শুধু উচ্চশিক্ষাকেই বাজার গ্রাস করেছে ভাবলে ভুল হবে। গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকেই গ্রাস করেছে, যা এখনও অত প্রকটভাবে বোঝা না গেলেও বুঝতে খুব বেশি দেরি হবে বলে মনে হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ শিক্ষাঙ্গনের বিভিন্ন স্তরে প্রায়ই অস্থিরতা চলে। সর্বশেষ আন্দোলন ছিল সম্ভবত শিক্ষার্থীর ওপর চাপানো ভ্যাট নিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর চাপানো ভ্যাট প্রত্যাহার করায় সমস্যার সমাধান হলেও কোন না কোনভাবে ভ্যাট ঠিকই শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চেপেছে। নয়া উদারবাদী ফর্মুলা তাই বলে। এ ফর্মুলার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা এদেশের কোন সরকারের নেই- শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম বাজেট বরাদ্দই তার প্রমাণ। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বরাদ্দের তুলনা তো চলেই না, এমনকি প্রতিবেশী ভারত বা শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও তুলনা চলে না। মুহম্মদ জাফর ইকবাল একবার তার লেখায় সরল হিসাব কষে দেখিয়েছিলেন সরকার গবেষণা খাতে পরিকল্পিতভাবে কিছু অর্থের যোগান দিলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে।

শিক্ষাক্ষেত্র কতটা অবহেলিত তার বহির্প্রকাশ মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত অষ্টম পে-স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা বৈষম্য। মুখ্য সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জ্যেষ্ঠ সচিব এবং তিন বাহিনীপ্রধানের জন্য ‘সুপার গ্রেড’ নামে বিশেষ গ্রেডের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পদমর্যাদা ও বেতনের দিক থেকে যাদের অবস্থান প্রথম গ্রেডের উপরে। পাশাপাশি সপ্তম বেতন স্কেল অনুযায়ী সিলেকশন গ্রেডের যে অধ্যাপকরা জ্যেষ্ঠ সচিবদের সমমর্যাদার অধিকারী ছিলেন, অষ্টম বেতন স্কেলে সিলেকশন গ্রেড তুলে দেয়ায় তারা সুপার গ্রেডের নিচে চলে গেছেন এবং ভবিষ্যতে কোন অধ্যাপকেরই আর সুপার গ্রেডে উন্নীত হওয়ার সুযোগ নেই। যার অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বেতন ও পদমর্যাদার দিক থেকে মুখ্য সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জ্যেষ্ঠ সচিব এবং তিন বাহিনীপ্রধানের থেকে নিচে থাকবেন। এটা শিক্ষকদের জন্য লজ্জা এবং অপমানকর। বিচ্ছিন্নভাবে সমস্যা সমাধানে পরিস্থিতি তাৎক্ষণিকভাবে শান্ত হলেও মূলে হাত না দিলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয় না। শিক্ষা এবং শিক্ষকদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন।

অর্থনীতিবিদ এ্যাডাম স্মিথের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রথম পরিচয় হয় উচ্চ মাধ্যমিকের অর্থনীতি ক্লাসে। পাঠ্য বইয়ে তাকে বিশেষায়িত করা হয়েছে ‘অর্থনীতির জনক’ বলে। তবে বইয়ের পড়া এবং শিক্ষকদের পড়ানো থেকে অর্জিত বিদ্যায় পরীক্ষার চৌকাঠ পেরোতে পারলেও এ্যাডাম স্মিথ ‘অর্থনীতির জনক’-এর বেশি কিছু তার সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানা হয় না। হায় মুখস্থ বিদ্যা! পরীক্ষা পাসেই সবশেষ। শিক্ষকও হয়ত অনার্স-মাস্টার্সের সাবজেক্ট বলে একটু বেশি মুখস্থ করেন। পার্থক্য এটুকুই।

আমাদের মতো উত্তর-উপনিবেশ দেশগুলোর পাঠক্রম, পাঠ্যবই এবং পাঠদানের পদ্ধতির ডিজাইনই এমনভাবে করা হয় যে, কিছু না শিখে না বুঝে ক্লাসের পর ক্লাস ভালভাবে উৎরানো যায়। পাঠ্য বিষয় শিক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন বা কৌতূহল জাগায় না।

যদি জাগাত তাহলে উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী প্রশ্ন করতে পারত কেন এ্যাডাম স্মিথকে অর্থনীতির জনকের সম্মান দেয়া হয়? শিক্ষক উত্তর দিতে পারতেন ‘কারণ তিনি অবাধ বা মুক্তবাজার অর্থনীতি মতবাদের জন্ম দিয়েছিলেন। যাকে বলে ধ্রুপদী উদারবাদী অর্থনীতি, তার জনক ছিলেন তিনি। ওই মতবাদের ওপর ভর করে গত শতকের আশির দশকের আগে থেকে আরেক দল অর্থনীতিবিদ গলা চড়াচ্ছেন। যাদের মতবাদ নয়া উদারবাদ নামে পরিচিত।’ আরও দু’কথা বাড়িয়ে তিনি হয়ত ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন- ‘আশির দশকের উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়ারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ-ি পেরোতে পেরোতে কিছুটা আঁচ হয়ত পাবে, কিন্তু তারপরের শিক্ষার্থীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে ততদিনে শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি নয়া উদারবাদের কব্জায় চলে যাবে।’

এসব কথা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীর পক্ষে বোঝা কঠিন নয়, যদি শিক্ষকের বোঝানোর ক্ষমতা না থাকে। তবে কঠিন হতে পারে এ্যাডাম স্মিথের সঙ্গে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের সম্পর্কে উৎস সন্ধান। সে জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয় আরও কয়েক বছর।

 

লেখক : মিলু শামস


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0057229995727539