শিক্ষকের শিরশ্ছেদ নিয়ে উত্তাল ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ফ্রান্স

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ক্লাসে মত প্রকাশের স্বাধীনতা শেখাতে ইসলামের নবীর কার্টুন দেখানোর পর থেকে হুমকির ভেতরে ছিলেন প্যারিসের উপকণ্ঠে এক স্কুলের ইতিহাস ও ভূগোলের শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি। কিছু মুসলিম অভিভাবক তাকে অপসারণের জন্য আন্দোলন করছিলেন। স্থানীয় একজন ইমামের নেতৃত্বে অনলাইনে এই নিয়ে প্রচারণাও চলছিল।

পুলিশের ভাষ্যমতে, সন্দেহভাজন ঐ হত্যাকারী মুসলিম তরুণ ৬০ মাইল দূরের এক শহর থেকে এসে ঐ শিক্ষককে খুঁজে বের করে ছুরি দিয়ে হত্যার পর তার শিরশ্ছেদ করে। প্যারিসের কাছে শুক্রবার দিনে-দুপুরে এক স্কুল শিক্ষকের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে ফ্রান্সে গত কয়েকদিন ধরে যে ক্ষোভ এবং আবেগের যে বিস্ফোরণ দেখা যাচ্ছে, তার নজির সেদেশে বিরল। বৃহস্পতিবার (২২ অক্টোবর) বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।

প্রতিবেদনে আও জানা যায়, শনিবার ও রোববার প্যারিসসহ ফ্রান্সের সমস্ত বড় বড় শহরে লাখ লাখ মানুষ ‘আমি ড্যানিয়েল প্যাটি‘ বা ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতেই হবে‘ এমন সব প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। আজ (বুধবার) রাষ্ট্রীয়ভাবে নিহত ঐ শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।

দু'হাজার পনের সালে ইসলামের নবীর কার্টুন প্রকাশের পর ব্যঙ্গাত্মক সাময়িকী শার্লি এব্দোর অফিসে ১২ জনের মৃত্যুর ঘটনার পর যে ক্ষোভ দেখা গিয়েছিল তার সাথে গত ক'দিনের বিক্ষোভের তুলনা করা হচ্ছে।

শুক্রবারই পুলিশের গুলিতে প্রধান সন্দেহভাজন আব্দুলাখ এ নামে ১৮ বছরের এক তরুণ পুলিশের গুলিতে মারা যায়। চেচেন বংশোদ্ভূত মুসলিম এই তরুণের বাবাসহ আরো ১৪ জনকে আটক করা হয়েছে।

বাড়ছে বিভেদের ফাটল

প্যারিসে সংবাদদাতা লুসি উইলিয়ামসন বলছেন, শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটির নৃশংস হত্যাকাণ্ড ফরাসী রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচিতি বা সত্ত্বা নিয়ে বিভেদ-বিতর্ক আরো তীব্র করে তুলেছে।

সংবাদদাতা বলছেন, এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে জাতীয় ঐক্যের বিরল এবং ‘নাটকীয় প্রদর্শন‘ দেখা গেলেও, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে ফরাসী সমাজের কিছু অংশের ভেতর আপত্তি তীব্র হচ্ছে।

রোববার ফরাসী একটি রেডিওতে ফাতিহা আগাদ বোঝালাত নামে মুসলিম এক ইতিহাসের শিক্ষক বলেন, “গত বছর এক ছাত্র আমাকে খোলাখুলি বলে যে নবীকে কেউ অশ্রদ্ধা করলে তাকে হত্যা করা পুরোপুরি বৈধ।“ ঐ শিক্ষক বলেন, “পরিবারের ভেতর যা শোনে, তার ভিত্তিতেই তাদের এ ধরণের মনোবৃত্তি তৈরি হয়।“

ফাতিহা বলেন, তিনি নিজেও গত কয়েক বছর ধরে মত প্রকাশের স্বাধীনতা শেখাতে ক্লাসে নবীর কার্টুন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কার্টুন, ইমানুয়েল ম্যাঁক্রর কার্টুন দেখিয়েছেন।

তিনি নিজে বড় কোনো হুমকিতে না পড়লেও, অনেক শিক্ষকই বেশ কিছুদিন ধরে বলছেন, ক্ষুদ্র হলেও স্কুলে শিক্ষার্থীদের একটি অংশের ভেতর ফরাসী আইন এবং মূল্যবোধ নিয়ে আপত্তি-ক্ষোভ জোরালো হচ্ছে।

ধর্মনিরপেক্ষতা - ফরাসি ভাষায় যাকে বলে ‘লাইসিতে‘ -- তা ফ্রান্সের জাতীয় পরিচয়ের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। ফরাসী বিপ্লবের পর থেকেই “মুক্তি, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব“ ফরাসী রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র, কিন্তু লাইসিতে বা ধর্মনিরপেক্ষতাও সমান গুরুত্ব পায় সেদেশে।

লাইসিতের মূল কথা হলো জনসমক্ষে - তা ক্লাসরুম হোক বা কাজের জায়গায় হোক - সেখানে ধর্মের কোনো কথাই চলবে না। ফরাসী রাষ্ট্রের কথা - কোনো একটি জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিকে রক্ষার জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ চাপালে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে।

কিন্তু এই তত্ত্ব যে অনেক নাগরিক এখন মানতে চাইছে না তার বহু প্রমাণ দিনকে দিন স্পষ্ট হচ্ছে। তারা দাবি করছে - ধর্মনিরপেক্ষতার পরিধি কমাতে হবে এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতায় রাশ টানতে হবে।

প্যারিসের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক মিশেল প্রাজার মতে, এই শতকের শুরুর দিকে যখন সরকার স্কুলে ধর্মীয় কোনো প্রতীক প্রদর্শন বা ব্যবহার নিষিদ্ধ করে তখন থেকেই এই বিদ্রোহের মনোভাব দেখা দিতে শুরু করে। মিশেল প্রাজা তখন প্যারিসের এক মুসলিম অধ্যুষিত শহরতলীর একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।

তিনি মনে করেন, ধর্মীয় প্রতীক নিষিদ্ধ করা নিয়ে শিক্ষার্থীদের একটি অংশের সাথে তাদের যে ফাটল তৈরি হচ্ছিল, শিক্ষকরা তাতে দরকার মত সাড়া দিতে ব্যর্থ হন। “ক্লাসে কোনো ছাত্র বা ছাত্রী যখন একটি সন্ত্রাসী হামলার সমর্থনে উল্লাস করে, তখন শিক্ষকদের উচিৎ চোখ বন্ধ না করে তা নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া, “ বলেন মিশেল প্রাজা।

“ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার আগে বা শিক্ষকের বিরুদ্ধে হত্যার হুমকি আসার আগেই বিষয়টি মোকাবেলা করা প্রয়োজন।“

ফ্রান্সে শিক্ষকরা বলছেন, ২০১৫ সালে নবীর কার্টুন ছাপা নিয়ে শার্লি এব্দো ম্যাগাজিনে সন্ত্রাসী হামলার পর এক শ্রেণীর শিক্ষার্থীর মধ্যে এই পরিবর্তন তারা বেশি করে লক্ষ্য করছেন।

দর্শনের শিক্ষক আলেকজান্ডার জিরাত বলেন, কিছু ছাত্র তাকে সেসময় বলেছিল শার্লি এব্দোতে হত্যাকাণ্ড সঠিক ছিল। “তাদের কথা ছিল - ঐ কার্টুন প্রকাশ মাত্রাতিরিক্ত, নবীকে এভাবে দেখানো ঠিক হয়নি।“

জনমত জরিপ বলছে, শুক্রবার শিক্ষকের হত্যাকাণ্ডের পর ফ্রান্সে জনমত আরো কঠোর হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজন মনে করেন, শার্লি এব্দোতে নবীর কার্টুন ছাপানো সঠিক ছিল। এর আগে, অধিকাংশ ফরাসী মনে করতো, এ ধরনের উস্কানির প্রয়োজন নেই।

তবে ঐ জরিপে মুসলিম উত্তরদাতাদের ৭০ শতাংশ মনে করেন, নবীর কার্টুন ছাপানো ভুল ছিল, তবে তারা সহিংসতার নিন্দা করেন।

বর্ণবাদ-বৈষম্য বনাম আনুগত্য

প্যারিসে লুসি উইলিয়ামসন বলছেন, ফ্রান্সে ধর্মীয় পরিচিতি এবং মত প্রকাশের মধ্যে এই বিরোধের বিষয়টি জটিল। এর সাথে বিভিন্ন মুসলিম দেশে যুদ্ধ-সংঘাত এবং সেই সাথে মুসলিম অভিবাসীদের একাংশের ভেতর বর্ণবাদ এবং বৈষম্যের অভিজ্ঞতার সম্পর্ক রয়েছে।

ফলে অনেকেই যুক্তি দেন, ফ্রান্সের জাতীয় মূলবোধ যদি একচোখা হয়, তাহলে তার প্রতি আনুগত্যে ঘাটতি হওয়ার ঝুঁকি থাকবেই।

প্রশ্ন হলো, ফরাসী সমাজের এই বাস্তবতায় স্যামুয়েল প্যাটির মত শিক্ষক - যাদেরকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা শেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে - তাদের কাছে বিকল্প কি?

রোববার প্যারিসে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক নারী বলেন, নেতাদের তৎপর হতে হবে। তিনি বলেন, “ এ ধরণের জটিল ধর্মীয়, নৈতিক এবং দার্শনিক প্রশ্ন সামলানোর জন্য আমরা শিক্ষকদের একা ছেড়ে দিতে পারিনা।“

ফরাসী রেডিওতে ইয়ানিস রোডার নামে ইতিহাসের একজন শিক্ষক বলেন, তারা এই বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষকে বেশ ক'বছর ধরে সতর্ক করছেন। “আশা করছি এই হত্যাকাণ্ডের পর তৃণমূলের বাস্তবতা নিয়ে সরকারের টনক নড়বে।“

‘চোখের পানি নয়, এখন দরকার অস্ত্র‘

প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ স্কুলে নিরাপত্তা জোরদার করতে প্রয়োজনীয় কর্ম-পরিকল্পনা তৈরির জন্য তার সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন।

মি. প্যাটির হত্যাকারীর সমর্থনে যে ৮০ জনের মত লোক গত ক'দিনে অনলাইনে পোস্ট দিয়েছে, তাদের তদন্ত করা হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে। যে সব প্রতিষ্ঠানের সাথে কট্টর ইসলামের যোগাযোগ আছে সেগুলোকে নতুন করে কঠোর নজরদারিতে আনার কথা বলা হয়েছে।

কট্টর ইসলামের মোকাবেলার প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রর সরকারের ওপর বেশ কিছুদিন ধরেই চাপ বাড়ছে।

শুক্রবারের হত্যাকাণ্ডের পর বিরোধী একজন সিনিয়র রাজনীতিক কট্টর ইসলাম মোকাবেলায় সরকারের কৌশলের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, “চোখের পানি নয়, এখন দরকার অস্ত্র।“

গত পাঁচ বছরে ফ্রান্সে ছোট-বড় বেশ অনেকগুলো সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনার পর মানুষের মধ্যে হতাশা এবং বিভেদ তীব্রতর হচ্ছে। একজন শিক্ষকের হত্যাকাণ্ডে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিক্রিয়া বোঝা যাবে যখন দু'সপ্তাহের ছুটির পর নভেম্বরের প্রথম দিকে স্কুল খুলবে।

দু‌'হাজার পনের সালে শার্লি এব্দো হত্যাকাণ্ডের মত নিহতদের স্মরণে দেশজুড়ে এক মিনিটের যে নীরবতা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল, তাতে বেশ কিছু মুসলিম শিক্ষার্থী অংশ নিতে অস্বীকার করেছিল।

আগামী মাসে স্কুল খোলার পর মি. প্যাটির স্মরণে একই ধরণের একটি কর্মসূচি নেয়ার পরিকল্পনা হয়েছে। আবারো হয়তো শিক্ষকরা দেখবেন কিছু শিক্ষার্থী তাতে অংশ নিতে অস্বীকার করছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031192302703857