শিক্ষা আইন যেন শুধু শিক্ষকদের শাসন করার জন্য না হয়

অধ্যক্ষ মো. আবুল বাশার হাওলাদার |

শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র পত্রিকা দৈনিক শিক্ষার প্রতিবেদনে দেখলাম খসড়া শিক্ষা আইন আবারো পরিমার্জন করতে যাচ্ছে সরকার। এর আগে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়েছিল শিক্ষা  আইনের খসড়া তৈরী। পরপর তিনবার মন্ত্রিপরিষদ থেকে থেকে ফিরে আসে পরিমার্জনের জন্য। সর্বশেষ ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে পাঠানো খসড়াটি ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে  ফেরত আসে পরিমার্জনের জন্য। আজ প্রায় নয় বছর ধরে চেষ্টা করে  শিক্ষা আইন চূড়ান্ত করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

প্রথমে যে খসড়া শিক্ষা আইন করা হয়েছিল তাতে দেখা যায়, ১১১টি ধারার মধ্যে ১৩টি ধারা মূলত আইন ছিল, বাকি ৯৮টি ধারা নীতিমালা ছিল। ১৩টি ধারা শুধু শিক্ষকদের শাসন করার জন্য ছিল। ৯৮টি ধারা আইন নয়,কারণ এগুলো ভঙ্গ করলে শাস্তি নেই। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, "আইন মানা বাধ্যতামূলক , না মানলে শাস্তি হবে" এটাই আইন। এই ভিত্তিতে শিক্ষা আইন করতে হবে। যে খসড়া আইন করা হয়েছিল তাতে শুধু শিক্ষকদের শাস্তির বিধান ছিল। সবাইকে মনে রাখা প্রয়োজন, শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত দেশের সকল মানুষ, শিক্ষা প্রশাসন থেকে শুরু করে সকল শ্রেণির মানুষ। তাই শিক্ষা আইন সকলের জন্য প্রযোজ্য,এইভাবে তৈরি করতে হবে। 

বর্তমানে দেশে নানারকম শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপদ্ধতি বিদ্যমান। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদরাসা, কারিগরি, প্রোফেশনাল, প্রশিক্ষণসহ নানা ধরণের শিক্ষা বিদ্যমান রয়েছে । তাছাড়া এসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নানাভাবে পরিচালিত। সরকারি,বেসরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত,প্রাইভেট, এমপিওভুক্ত, ননএমপিও, অনুমোদিত,অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলো ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে ও নিয়মে পরিচালিত। এসব প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এসকল প্রতিষ্ঠানের জন্য একই আইন প্রযোজ্য হবে না। তাছাড়া শিক্ষা আইনের আওতায় সংশ্লিষ্ট সকলকে আনতে হবে।

খসড়া শিক্ষা আইনের একটি ধারায় আছে, নির্দিষ্ট সংখ্যক জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমি বলছি, এটি আইন নয়। হ্যাঁ, এটি যদি আইন হয় তবে প্রতিষ্ঠা না করলে শাস্তি কী, কার শাস্তি হবে উল্লেখ থাকতে হবে।

শিক্ষা আইনের খসড়া দেখে মনে হয় এটি বেসরকারি শিক্ষকদের  শাস্তি দেওয়ার জন্য করা হয়েছে। আমি আবারো বলছি, শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করতে ও জবাবদিহির আওতায় আনতে শিক্ষা আইন করতে হবে।

আমরা জানি, দেশের শতকরা ৯৭ ভাগেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হতো। পরে ১৯৭৯, ১৯৮৯, ১৯৯৫, ২০১২, ২০১৩ এবং ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ঘোষিত নির্দেশিকা,নীতিমালা, জনবল কাঠামো, এমপিও নীতিমালা নামে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য বিধিবিধান বিদ্যমান আছে।। তাছাড়া মাঝেমধ্যে পরিপত্র- প্রজ্ঞাপন জারি করে সাময়িক কাজ সম্পন্ন করা হয়।বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতের রায় আইনে পরিণত হয়েছে। এসব রায় অনুসরণ করে শিক্ষামন্ত্রণালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করছেন। আবার বেসরকারি ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব কিছু নিয়মকানুন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।

শিক্ষা আইন প্রণয়ন বা পরিমার্জন করতে হলে উপরোল্লিখিত বিধিবিধান সমন্বয় করে সম্পন্ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রচলিত ফৌজদারি আইনের সাথে সাংঘর্ষিক না হয় শিক্ষা আইন।

দৈনিক শিক্ষার প্রতিবেদন মতে, আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর এ ব্যাপারে সভা হওয়ার কথা। অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা থাকবেন সেখানে। ভালো কথা, এর আগেও জ্ঞানীগুণীরা ছিলেন; কিন্তু পারেননি। সে বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে। তবে আমার পরামর্শ হলো, ঐ কমিটিতে আইন বিশেষজ্ঞ ও মাঠ পর্যায়ে কাজ করা শিক্ষা বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে শিক্ষা আইন  দরকার। আর শিক্ষাআইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা এবং বিভিন্ন ধারার শিক্ষাপদ্ধতি একই ধারায় ফিরিয়ে আনা অর্থাৎ একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা।

আমি শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের কথা বলছি,মনে করুন, একজন সরকারি শিক্ষক বিধি বহির্ভূত কোনো কাজ করলে তাকে বদলী করা হয় আর বেসরকারি শিক্ষকের শাস্তি চাকরচ্যুতি, বদলীর ব্যবস্থা নেই বলে। জাতীয়করণে এ বৈষম্য দূর হবে। 

খসড়া শিক্ষা আইন মন্ত্রিপরিষদে পাঠানোর পূর্বে অভিজ্ঞদের মতামত বিশেষ করে শিক্ষকদের মতামত নেওয়া সমীচীন হবে বলে মনে করি। পরিশেষে বলতে চাই, শিক্ষা আইন হতে হবে আধুনিক শিক্ষার জন্য, শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য, শিক্ষকের মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য, শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য। শিক্ষাবান্ধব শিক্ষাআইন কবে বাস্তবের মুখ দেখবে সেই প্রত্যাশায় আজকের মতো শেষ করছি।

অধ্যক্ষ মো. আবুল বাশার হাওলাদার : সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়ন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ - dainik shiksha স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে - dainik shiksha শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004148006439209