শিক্ষা প্রশাসনে ওরা ১১ জন, সিন্ডিকেট ভাঙতে সময় চেয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

এন্তার অভিযোগে ঢাকা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক ড. মো. আশফাকুস সালেহীনকে গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি যশোর এম এম কলেজে বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু বছরখানেক পরই তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে এনে ১৫শ কলেজ স্থাপন প্রকল্পের পিডি পদে পদায়ন করা হয়েছে। বোর্ডে থাকতে তিনি কলেজ পরিদর্শন এবং অনলাইনে ভর্তির মেধা তালিকা তৈরি করতে অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। তার আগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ শাখার উপপরিচালক থাকতেও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন অভিজিৎ ভট্টাচার্য।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নানা অভিযোগে ঢাকা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক এটিএম মঈনুল হোসেনকে খুলনা সরকারি কলেজে বদলি করা হয়েছিল। তিনিও ঢাকা কলেজের উপাধ্যক্ষ হয়ে ফিরে এসেছেন চলতি বছরের ২৭ মে। জেএসসি পরীক্ষার ফল জালিয়াতির অভিযোগে ঢাকা বোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে থাক মাসুদা বেগমকে  বরিশাল বিএম কলেজের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে বদলি করা হয়েছিল। পরে প্রথমে কুমিল্লা ও সর্বশেস তদবিরের মাধ্যমে নায়েমের উপপরিচালক পদ বাগিয়ে নিয়েছেন গত ৩০ মে। কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কায়সার আহমেদকে গত বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর সরকারি কলেজে বদলি করা হয়েছিল। সেখান থেকে নভেম্বরে বদলি হয়ে যান চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজে। চাঁদপুর থেকে তিনি মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়ে এসেছেন গত ১৩ জুন। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে ঢাকা বোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদ থেকে অধ্যাপক আবুল বাশারকে বদলি করা হয়েছিল। তিনিও গত ২৪ মার্চ ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে ফিরে এসেছেন।

এভাবে গত ১০ মাস ধরে শিক্ষা প্রশাসনে যে ‘সিন্ডিকেটরাজ’ চলছে, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির কাছে গিয়ে তা তুলে ধরেছেন ঢাকার বিভিন্ন সরকারি কলেজের সিনিয়র অধ্যাপক ও বিসিএস শিক্ষা সমিতির একাংশের নেতৃবৃন্দ। গত ২৭ অক্টোবর রাতে শিক্ষামন্ত্রীর হেয়ার রোডের বাড়িতে গিয়ে শিক্ষকরা এসব অসন্তোষ জানিয়েছেন। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে শিক্ষামন্ত্রীর সামনে শিক্ষা প্রশাসনের অরাজকতা সম্পর্কে নানা বক্তব্য দেন তারা। সব শুনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি শিক্ষকদের কাছে কিছু দিন সময় চেয়ে বলেন, ‘আমি পুরো ঘটনার নেপথ্যে কী আছে তা আগে জানার চেষ্টা করি। তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দিকে অগ্রসর হবো। অন্যদিকে গত ২৪ অক্টোবর অধ্যাপক শাহেদুল খবীরের নেতৃত্বে ১০ জন শিক্ষক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির কাছে নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়ে আসেন।

জানতে চাইলে সরকারি কবি নজরুল কলেজের অধ্যক্ষ ও বিসিএস শিক্ষা সমিতির বিদায়ী কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্ল্যাহ খন্দকার বলেন, শিক্ষামন্ত্রী আমাদের সব বক্তব্য শুনেছেন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিয়েছেন। মন্ত্রী এসব সমস্যা নিরসনে শিক্ষকদের কাছে সময় চেয়েছেন বলেও জানান তিনি। তবে এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে বিসিএস শিক্ষা সমিতির বিদায়ী কমিটির মহাসচিব ও মাউশি অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক শাহেদুল খবীর চৌধুরী বলেন, তারা যেমন শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছে তেমনি আমিও দেখা করেছি। আমি তো কারো বিরুদ্ধে মন্ত্রীর কাছে বলিনি। তবে শিক্ষা প্রশাসনে যা ঘটছে সে বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে ধারণা দিয়েছি। আমি জেনেশুনে বিএনপি-জামায়াতকে তো বিসিএস শিক্ষা সমিতির চেয়ার কিংবা অন্য কোথাও বসাতে পারি না। সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষা প্রশাসনে এমন কিছু আছে বলে আমার জানা নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে শিক্ষা প্রশাসনে ১১ জনের সিন্ডিকেট রয়েছে। এরাই শিক্ষায় কার কোথায় বদলি হবে তা ঠিক করে দেন। এর মধ্যে রয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক শাহেদুল খবীর চৌধুরী, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক তপন কুমার সরকার, এনসিটিবি সচিব ড. নিজামুল করিম, ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক আবুল বাশার, ঢাকা বোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আল মাসুদ করিম, মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কায়সার আহমেদ, নায়েমের উপ-পরিচালক মাসুদা বেগম, বাঙলা কলেজের উপাধ্যক্ষ শহীদুল ইসলাম, ঢাকা কলেজের উপাধ্যক্ষ এটিএম মঈনুল হোসেন, সাভার কলেজের অধ্যক্ষ ইমরুল হাসান এবং সাবেক ছাত্রদল নেতা ও মাউশির উপপরিচালক (বিশেষ) সৈয়দ মইনুল হাসান।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ২০১৮ সালে শিক্ষা প্রশাসনের কর্মরত এদের প্রায় প্রত্যেককে ঢাকার বাইরে বদলি করেছিলেন। কিন্তু ভোটের পরে নতুন সরকার গঠন হলে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীকে নানা উছিলায় বুঝিয়ে সেই সিন্ডিকেটের সব সদস্যই ঢাকায় শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ফিরে এসেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, যাদের পদায়ন করা হয়েছে তারাই ঘুরে-ফিরে কখনো বোর্ডে, কখনো মাউশি, কখনো এনসিটিবি, কখনো ডিআইএতে চাকরি করছেন। তারা সবাই সিন্ডিকেট মেম্বার। এদের মোড়লগিরিতে শিক্ষা ক্যাডারে নীরব কান্না চলছে।

জানা গেছে, ২৭ অক্টোবরের বৈঠকে শিক্ষকরা সিন্ডিকেট নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও মূলত মাউশি পরিচালক ও সিন্ডিকেট প্রধান অধ্যাপক শাহেদুল খবীর চৌধুরীর বিরুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি অভিযোগ দিয়েছেন। শিক্ষকরা বলেছেন, অতিরিক্ত পদে শাহেদ পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপক হয়েছেন। অধ্যাপক হয়েই তিনি মাউশি পরিচালক পদটি বাগিয়ে নেন। এর আগে তিনি ঢাকা বোর্ডের সচিব ছিলেন। পরিচালক হয়ে তিনি ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ধরা খেয়েছেন। শুধু তারই কারণে বিসিএস শিক্ষা সমিতির নির্বাচনও হতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

মন্ত্রীকে শিক্ষকরা বলেছেন, অধ্যাপক শাহেদ শিক্ষা প্রশাসনে রাজত্ব তৈরি করেছেন। মাউশি পরিচালক সিনিয়র অধ্যাপকের পদ। কোনোভাবেই শাহেদের মতো জুনিয়ররা এই পদে নিয়োগ পেতে পারেন না। তখন শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকদের বলেন, জুনিয়র একজন পদায়ন পেলে কী সমস্যা? এর জবাবে শিক্ষকরা বলেন, নিশ্চয়ই আপনি চাইবেন না কোনো জুনিয়র তার সিনিয়রের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন লিখে সই করুক। এ ছাড়া এদের ঘুরে-ফিরে শিক্ষা প্রশাসনে পদায়ন দিয়ে কী লাভ হয় তাও জানতে চান শিক্ষকরা।

এদিকে কোনো ধরনের সিন্ডিকেটে যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন অভিযুক্তরা। এ বিষয়ে ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক আবুল বাশার বলেন, শিক্ষা প্রশাসনের সিন্ডিকেট সম্পর্কে আমি জানি না। তবে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা প্রশাসনে এই সিন্ডিকেটের নাম শুনে আসছি। বাস্তবে এসব হচ্ছে স্থুল কথা। এসবে পাত্তা দিতে নেই।


মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কায়সার আহমেদ বলেন, সিন্ডিকেটে আমার নাম কীভাবে এসেছে আমি জানি না। এ ধরনের কাজে আমি জড়িতও নেই। অন্যরাও প্রায় একই কথা বলেছেন। তারা বলছেন, শিক্ষা প্রশাসনে কোনো সিন্ডিকেট নেই এবং তারাও কোনো সিন্ডিকেটে জড়িত নন। এটি বিরোধীদের অপপ্রচার।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028879642486572