শিক্ষা হোক চিন্তাশীলতা সৃষ্টি ও আনন্দের উৎস

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী |

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। এ অধিকারের ক্ষেত্রটি সবার জন্য উন্মুক্ত হলেও কী পদ্ধতিতে শিক্ষাকে বিন্যাস করলে তা জীবনমুখী শিক্ষায় পরিণত হতে পারে, তা নিয়ে আমাদের তেমন কোনো গবেষণা নেই। 

শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মনের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে কীভাবে মানুষের চিন্তাশক্তিকে বিকশিত করা যায়, তার কৌশল নিয়ে আমরা খুব একটা ভাবছি না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন, আনন্দের মাধ্যমেই শিখনফল অর্জিত হয়। যে শিক্ষায় আনন্দ নেই, সেই শিক্ষা মূল্যহীন।

আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষার প্রধান সমস্যা হল, আমরা শিক্ষাকে কঠিন করে ফেলার কারণে মানুষ ধীরে ধীরে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ফলে তার সৃষ্টিশীল চিন্তার বিকাশ না ঘটে বরং তা কমতে থাকে। কিন্তু বিষয়টি উল্টো হতে পারত, যার ফল রাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক হতো।

শিক্ষার বিড়ম্বনার কারণে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ থেকে সরে না গিয়ে বরং শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হতে পারত। এ আগ্রহ সৃষ্টির জায়গাটি আমাদের তৈরি করতে হবে। মানুষ শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ হারিয়ে ফেললেও নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা চিন্তা করে শিক্ষা গ্রহণ করছে; কিন্তু শিক্ষার মাধ্যমে নিজের চিন্তার উৎকর্ষ সাধনের জায়গাটি তার অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে।

এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। আমাদের যে পাঠ্যপুস্তক রয়েছে, এগুলো থেকে অর্জিত জ্ঞান কীভাবে মানুষের জীবনে কাজে লাগানো যায়; তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ফলে লক্ষ্যহীন শিক্ষা না পারছে আনন্দের অনুসর্গ হিসেবে কাজ করতে, না পারছে চিন্তাশীলতার জায়গা সৃষ্টি করতে।

আবার প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বইগুলোর মধ্যে যে সম্পর্ক বা ধারাবাহিকতা থাকার কথা ছিল, সেটিও নেই। বইগুলোর বিষয় নির্বাচন ও লেখার ক্ষেত্রে কোনো পরিকল্পিত চিন্তা ও পরিকল্পনা নেই। শিক্ষা গবেষণায় দেখা যায়, যে কোনো ধরনের বই- সেটা হতে পারে বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস কিংবা সমাজবিজ্ঞানের; সেগুলোকে কথাসাহিত্যের আদলে সহজভাবে লিখতে পারলে তা মানুষের মধ্যে চিন্তাশীলতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে।

গতানুগতিকভাবে মুখস্থ না করে মানুষ মৌলিক কিংবা ফলিত জ্ঞানকে সারা জীবন মনে রাখতে পারে এবং কর্মক্ষেত্র ও জীবনে তার প্রয়োগ করতে পারে। শিক্ষার একটি প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের মধ্যে ইতিবাচক কল্পনাশক্তি সৃষ্টি করা। এটি সম্ভব সৃজনশীল ধারণা সৃষ্টির মাধ্যমে।

যেমন- একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের গল্পের মাধ্যমে বিজ্ঞানের কোনো একটি বিষয় তুলে ধরে এর সম্ভাব্য ফল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরতে পারে। এভাবে ওই বিষয়টিতে শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হবে এবং তাদের নিজের ভাবনা বা মতামত জানাতে পারবে। হতে পারে সেটা ভুল কিংবা শুদ্ধ।

কিন্তু বিভিন্ন শিক্ষার্থীর চিন্তার ভিন্নতা যেমন এ ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে, তেমনি শিক্ষার্থীরা চিন্তাশক্তি প্রয়োগের সুযোগ পাবে। এ ধরনের শিক্ষা প্রক্রিয়া প্রতিটি বিষয়ের ক্ষেত্রেই থাকতে হবে। এতে করে একজন শিক্ষার্থী এক শিক্ষা স্তর থেকে আরেক স্তরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তার মেধার বিকাশও ঘটতে থাকে।

আরেকটি বিষয় ভাবা যেতে পারে তা হল, শিক্ষাস্তরের ভিত্তিতে বিভিন্ন শিক্ষামূলক খেলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভেতরের চিন্তাশক্তিকে বের করে আনা। নিচের শিক্ষাস্তরের শিক্ষামূলক খেলাগুলো খুব সহজ হবে এবং যতই শিক্ষাস্তরের ওপরের ধাপে একজন শিক্ষার্থী যাবে, তার শিক্ষামূলক খেলাগুলোও ততবেশি সৃজনশীল হবে ও তার চিন্তাশীলতার পরিধি বাড়বে।

তবে শিক্ষামূলক খেলাগুলো যাতে শিক্ষার্থীদের মনের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে, তার মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা থাকতে হবে। শিক্ষাজীবনের প্রথম স্তর থেকেই ছোট ছোট বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শেখানোর চর্চা থাকতে হবে।

পৃথিবীর উন্নত শিক্ষাব্যবস্থাগুলোয় শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক স্তরে জীবনাচরণের শিক্ষা দেয়া হয়। যেমন- কীভাবে রাস্তা পার হতে হয়, কীভাবে মিলেমিশে কাজ করতে হয়, কীভাবে মানুষ ও সমাজের উপকার করতে হয়, কোনটা ভালো কোনটা মন্দ এবং কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা- কীভাবে তা যাচাই করতে হয়, কীভাবে বড়-ছোটদের প্রতি আচরণ করতে হবে, প্রকৃতিকে কীভাবে চিনতে ও জানতে হবে, বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা কীভাবে রোধ করা যাবে, বিজ্ঞানকে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, দেশকে কেন ভালোবাসতে হবে, কোনো একটি বিষয় কীভাবে উপস্থাপন করতে হবে; এ বিষয়গুলো আনন্দ ও খেলার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হয়।

শিক্ষার সব স্তরে আমাদের স্বাধীনতা, ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিকভাবে জ্ঞান আহরণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দেশে শিক্ষাজীবনে প্রবেশের শুরু থেকেই একজন শিক্ষার্থীকে বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়, যা তার মনে শিক্ষার প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা গড়ে তোলে।

যেমন- পরীক্ষার মাধ্যমে যখন শিক্ষার্থীর মেধা মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়, তখন শিক্ষার্থীর প্রাথমিক স্তরেই একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ভারসাম্যহীন মানসিকতা গড়ে ওঠে। ফলে তার সহপাঠী একজন মানুষ না হয়ে তার কাছে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যায়। এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাবের কারণে শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর যে প্রকৃত মেধার বিকাশ ঘটার কথা ছিল, তা বাধাগ্রস্ত হয়।

এর দীর্ঘমেয়াদি পরিণতিতে একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে তার সঙ্গে অধ্যয়নরত অন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি মানবিক ও সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে না। বরং সংকীর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও সমষ্টিগত মনোভাবের সমন্বয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়নে কাজ করতে পারে না।

এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীস্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পায়। কাজেই প্রাথমিক স্তরে কোনো ধরনের পরীক্ষা না রেখে কীভাবে শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে মেধার মূল্যায়ন করা যায়, সে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।

জাপান, সুইডেন, ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলো ইতিমধ্যেই পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষাপদ্ধতি গড়ে তুলেছে। এর ফলে এসব দেশে শিক্ষার্থীর মেধা যেমন বেড়েছে, তেমনি মানবিক প্রগতি অর্জনও সম্ভব হয়েছে। শিক্ষা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে। গবেষণার মাধ্যমেই আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে ফলপ্রসূ শিক্ষাপদ্ধতি বের করে আনা সম্ভব।

শিক্ষা গবেষণা ও শিক্ষা গবেষকের গুরুত্ব অনুধাবন করে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নরওয়ে, কোরিয়া ইত্যাদি দেশে শিক্ষা নিয়ে পড়ার জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। বিষয়টি আমাদের দেশেও ভাবা যেতে পারে।

কারণ গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষার ভিত্তি গড়ে না উঠলে শিক্ষার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করে রাষ্ট্রের উন্নয়নে দক্ষ ও মেধাবী জনশক্তি গড়ে তোলা যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে এ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ক্ষেত্রটি আমাদের দেশে এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। আর যেটুকু গবেষণা হচ্ছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে সেভাবে এর বাস্তব প্রয়োগ লক্ষ করা যাচ্ছে না।

এর মূল কারণ হচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমরা যত বেশি আলোচনা করছি; শিক্ষা গবেষণা নিয়ে সেভাবে কোনো আলোচনা নেই। আশার কথা হচ্ছে, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘শিক্ষার সফলতা আরও সুসংগঠিত করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। অব্যাহত থাকবে শিক্ষার মানোন্নয়নের।

দেশে শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় টিম হিসেবে আমরা কাজ করব। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মানোন্নয়নসহ স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা দরকার। সমালোচনাকে গ্রহণ করার মানসিকতা থাকবে। কোথাও কোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন করার প্রয়োজন হলে তা করব।’

এখানে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। তা হল, শিক্ষার সফলতা ও সুসংগঠিতকরণ, শিক্ষার মানোন্নয়ন, টিম ওয়ার্ক বা গ্রুপভিত্তিক প্রচেষ্টা, জবাবদিহিতা, সমালোচনাকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখা ও পরিবর্তন।

প্রকৃত শিক্ষার স্বরূপ উন্মোচন করে শিক্ষার্থীর চিন্তাশীলতাকে বের করে আনার মধ্যেই রয়েছে শিক্ষার সফলতা। গ্রুপভিত্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন করে কীভাবে এটিকে বিশ্বমানের করা যায়, সেটি নিয়েও ভাবতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের জন্য যে পরিবর্তন ও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে, তা করতে হবে। এভাবেই শিক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে।

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

[email protected]

সৌজন্য: যুগান্তর


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064749717712402