শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য

মুহাম্মদ মিজানুর রহমান |

বর্তমান শতাব্দী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। তাই একটি টেকসই শিক্ষানীতির পাশাপাশি প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থার। এ লক্ষ্যে সরকার গ্রহণ করেছে নানামুখী প্রচেষ্টা, যা শিক্ষাবান্ধব সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন। সরকারের যে কোনো পদক্ষেপের সফলতা নির্ভর করে জনগণের স্বতঃস্ম্ফূর্ত সমর্থনের ওপর। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির শুরুতে শিক্ষিত সমাজ ও সুধীজন সাদরে গ্রহণ করলেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তারাই প্রশ্ন তুলেছেন এ বিষয়টি ঘিরে। এর অন্যতম কারণ, সৃজনশীল পদ্ধতি যে উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে, প্রকৃত অর্থে এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। একদিকে সরকার কর্মদক্ষতাসম্পন্ন সৃজনশীল মানুষ তৈরির মানসে অবিরত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; অন্যদিকে দায়িত্বের অবহেলা। সব মিলিয়ে এক বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তাই প্রথমেই উচিত এর যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করে একটি সুন্দর পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। বর্তমান বাস্তবতায় গাইড বই একটি বড় সমস্যা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশে অন্যতম একটি বাধা। 

জানুয়ারিতে বিদ্যালয়গুলোতে শুরু হয় গাইড বইয়ের রমরমা প্রচার। বিভিন্ন প্রকাশনীর প্রতিনিধিরা ঘুরছেন শিক্ষকদের দ্বারে দ্বারে। এ রকম কথাও শোনা যায়, কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানরা প্রকাশনী থেকে মোটা অঙ্কের ডোনেশন নিয়ে নির্দিষ্ট প্রকাশনীর বই চড়া দামে কিনতে বাধ্য করেন। বোর্ড বইয়ের বাইরেও অতিরিক্ত বই কিনতে বাধ্য করেন। বছর শেষে এমনও দেখা যায়, একজন শিক্ষার্থী চার থেকে পাঁচটি গাইড বই কিনছে। কারণ প্রশ্ন হয় গাইড বই থেকে। শত ভাগ নম্বর পাওয়ার নিশ্চয়তায় সব গাইড বই তাদের কিনতে হয়। দেখা যায়, অধিকাংশ শিক্ষক গাইড বই থেকে প্রশ্নপত্র তৈরি করলেও কিছু শিক্ষক নিজেরা মেধা ও শ্রম দিয়ে প্রশ্নপত্র তৈরি করেন। কিন্তু এত সবের মধ্যে তাদের সেই পরিশ্রমের মূল্যায়ন কোথায়? বর্তমান শিক্ষা আইনে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব ধরনের নোট ও গাইড বই নিষিদ্ধ। কে মানছে সে আইন? শিক্ষা প্রশাসনও দায়িত্ব পালনের নামে বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে।

দেখভাল করার দায়িত্ব তাদের থাকলেও মাঠ পর্যায় গিয়ে কাজ করছে না তারা। শিক্ষকরাও আইন মানছে না। যদি গাইড বই থেকে প্রশ্ন করায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেত, তাহলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। সরকারের সব সুবিধা নেওয়া সত্ত্বেও একজন শিক্ষক কেন সৃজনশীল হতে পারছেন না- বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। যেখানে একজন শিক্ষক নিজেই সৃজনশীল হতে পারলেন না, তিনি কীভাবে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল হিসেবে গড়ে তুলবেন? শিক্ষায় মাধ্যমিক স্তরটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এটিই সবচেয়ে অবহেলিত। সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ করছে। যদি একটি বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা জাতীয়করণের মাধ্যমে দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা ভোগ করতে পারেন, তাহলে একজন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কেন প্রথম শ্রেণি পদমর্যাদা ভোগ করতে পারবে না! তাদের জন্য অভিশাপ, তারা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন।

এই অধিদপ্তরের বড় পদগুলো দখল করে আছে কলেজ প্রশাসন থেকে আসা শিক্ষা ক্যাডারের লোকগুলো। ফলে তারা সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা ভাবছেন না। কেবল নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। তাই এই সমস্যা নিরসনে দরকার সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের জন্য আলাদা একটি অধিদপ্তর। একজন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরি জীবনের অধিকাংশ সময় কেটে যায় একই পদে থেকে। দেখা যায়, কেউবা সহকারী শিক্ষক হিসেবে অবসর নিচ্ছেন। তাদের কোনো প্রমোশন নেই। নেই ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা। 

শিক্ষকদের অবশ্যই একটি নিয়মনীতির আওতায় আনা দরকার। এ জন্য তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এরপরও কেউ আইন লঙ্ঘন করলে সরকার তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। সমাজের আর দশজন মানুষের মতো শিক্ষকরা ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে পারেন। সুতরাং একটি মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধানে অবশ্যই শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের জবাবদিহির আওতায় আনাও জরুরি। শিক্ষকদের অবশ্যই সম্মানজনক জায়গায় বসাতে হবে। প্রয়োজনে অবশ্যই তাদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা সময়ের দাবি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কলেজ শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঝে যে বেতন বৈষম্য রয়েছে, তা দূর করা একান্ত প্রয়োজন। এ জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ও উচ্চতর ডিগ্রি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যতদিন না আমাদের শিক্ষক সমাজ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে, ততদিন এ জাতির ভাগ্যোন্নয়ন হবে না। 

 

গবেষক , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

 

সৌজন্যে: সমকাল


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি - dainik shiksha পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026400089263916