শিক্ষার বরাদ্দ আশানুরূপ না হলেও দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক

আমিরুল আলম খান |

চালাকিটা পুরানো। শিক্ষাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে না দেবার চালাকি। ফৌজি হুকুমতে শিক্ষার সাথে জুড়ে দেয়া হতো খেলাধুলা, যাতে বরাদ্দের অঙ্কটা বড় দেখায় আর প্রচার করা যায় হুকুমত জ্ঞানচর্চায় বহুত আগ্রহী। এবারও তার অন্যথা হলো না।

তের সংখ্যাটা নাকি ফুঁকোবাজির দ্যোতক। কী জানি? তবে শিক্ষায় এক লাফে বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮ থেকে বেড়ে ৩ দশমিক ০৪ করার প্রচারে অন্যদের মতো আমিও তা বিশ্বাস করেছিলাম, কিছুটা অবাক হয়েই। তবু, সাধুবাদ জানিয়েছিলাম এই ভেবে যে, শিক্ষার যে আনুভূমিক প্রসার ঘটেছে এবার গুণগত মানোন্নয়নে হুকুমতের নজর অসম্ভব নয়। বিশেষ করে যখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাপানের গৌরব সম্রাট মেইজিকে সামনে এনেছেন।

কিন্তু পরে যখন স্পষ্ট হল, গতবারের মতোই এবারও শিক্ষার সাথে প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ জুড়ে দিয়ে তাকে সর্বোচ্চ দেখানো হয়েছে, আর বাস্তবে বরাদ্দ বেড়েছে, জিডিপির হিসেবে মাত্র দশমিক শূন্য এক ভাগ। তখন নিজের চুল না ছিঁড়ে উপায় কী?

তবু এবারের শিক্ষা বাজেটে আমি অন্তত স্বস্তিবোধ করছি যে, দীর্ঘকাল আন্দোলন সংগ্রাম শেষে এবার তাদের অন্তত মনুষ্যজীব হিসেবে মানতে হুকুমত রাজি হয়েছে। দৈনিক শিক্ষা ১৪ জুনে খবর লিখেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এখনও সবচেয়ে কম! অথচ, আগের দিনের খবরে কোথায় যেন একটা গলদ ছিল যে, শিক্ষায় এবার বরাদ্দ ৩ দশমিক ০৪ ভাগ! আসলে প্রকৃত বরাদ্দ মাত্র ২ দশমিক ২ ভাগ! তার মানে দাঁড়ায়, বাজেটের ১৬ ভাগ বরাদ্দের খবরও নাকচ হয়ে গিয়ে তা নামতে বাধ্য। সে হিসেবে গিয়ে আমি মনটা খারাপ করতে চাইনে।

এবারে শিক্ষা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর  আরেকটি অবস্থান আমার ভালো লেগেছে। তা হল, তিনি স্পষ্ট বলেছেন, ভালো শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে চাই ভালো শিক্ষক। শিক্ষকদের সম্পর্কে গত কয়েক বছরে শাসক শ্রেণির লাগামহীন বক্তব্যের বিপরীতে এই অবস্থান। মেনে নেয়া হল যে, শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়নে আমাদের প্রয়াস যথেষ্ট নয়। তাই তাদের দেশে-বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।

এই উপলব্ধি বা স্বীকৃতি হয়ত দীর্ঘদিনের আমলা প্রাধান্যের বিপরীতে সঠিক রাস্তায় ফিরে আসার বার্তা দিচ্ছে। তবে, গোড়ার গলদ দূর না করলে, শুধু উপলব্ধি খুব ফল দেবে না। সবচেয়ে বড় গলদ হলো, শিক্ষক নিয়োগে দলবাজি ও দুর্নীতি। তার শেকড় অনেক গভীরে। সে শেকড় উপড়ে ফেলা কঠিন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাম্প্রতিক জাপান সফরের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছেন, দরকারে বিদেশ থেকে ভালো শিক্ষক আনবেন তিনি। এর বেশি যেহেতু খোলসা করে প্রধানমন্ত্রী কিছু বলেননি, তাই আগ বাড়িয়ে কিছু অনুমান করতে চাই না।

আমরা এটা জেনেছি, কয়েকবছর আগে সরকার আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করেছেন। সেখানে শিক্ষার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা আছে বলে আমার মনে হয়েছে। কয়েকটি বিষয়ে সরকারের উপলব্ধি আমাদের আশান্বিত করে। যেমন, সৃজনশীল প্রশ্নপত্র শিক্ষাদান পদ্ধতিকে সৃজনশীল করতে পারেনি। অর্থাৎ, শুধু প্রশ্নপত্র সৃজনশীল হলেই শিক্ষাদান পদ্ধতি আপনা-আপনিই সৃজনশীল হয়ে যায় না। আবার, শিক্ষকরাও সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে দক্ষ হয়ে ওঠেনি। সরকারের নিজের করা সমীক্ষা জানান দিচ্ছে, পড়ুয়ারা ইংরেজি দূরে থাক, বাংলাও আশানুরূপ শিখতে পারছে না। গণিতে অবস্থা আরও ভয়াবহ।

গত এক দশক ধরে এ কথাগুলো আমরা বারবারই বলে এসেছি। বলেছি, পরীক্ষায় পাসের উচ্চ হার আর পড়ুয়াদের অর্জিত দক্ষতায় বিরাট ফারাক থাকছে। সতর্ক করেছি, সময়ের এক ফোঁড়ের মতো এ পরীক্ষা বিলাস ত্যাগ না করতে পারলে সমূহ বিপদ সামনে অপেক্ষা করছে। কিন্তু গায়ের জোরে এসব সতর্কবার্তা শুধু অস্বীকার করা হয়নি, বরং নানাভাবে একটি ভুল পথে চলার পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়েছে। 

আমরা এখন একটু স্বস্তিবোধ করতে পারি এই ভেবে যে, শিক্ষা যে জীবন দক্ষতা অর্জনের সোপান সেটি সরকার মেনে নিয়েছেন। শিক্ষা কেবল তখনই সৃজনশীল হয়ে ওঠে যখন শিশু তার প্রাত্যহিক প্রয়োজনে জীবন দক্ষতা শেখার সুযোগ পায়। শিক্ষা তখন হয়ে ওঠে আনন্দের। কিন্তু আমাদের পাঠ্যক্রম কেবলই মুখস্তনির্ভর, তাই নিরানন্দময়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় জীবন দক্ষতাভিত্তিক যে নতুন পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, সেটি এখনো আঁতুড় ঘরে। এ পর্বে কোনো মন্তব্য করা উচিত হবে না। তাই আমরা শুধু আশাবাদ ব্যক্ত করে অপেক্ষা করতে চাই।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় যে সংস্কার দরকার তা হল, অন্তত আগামী ৫০ বছরে জাতীয় চাহিদা নির্ণয় করা। সেই সাথে বৈশ্বিক চাহিদার কথাও মাথায় রাখা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর বর্তমান বিশ্বে প্রাযুক্তিক দক্ষতা অর্জন দরকার সবার আগে। আমাদের শিক্ষাক্রমে তার প্রকট অভাব। প্রযুক্তি শিক্ষায় আমরা বেহুদা তত্ত্বের ওপর জোর দিচ্ছি। আসলে জোর দিতে হবে ব্যবহারিক কর্মতৎপরতার ওপর। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তত্ত্বের কচকচানি চলে, হাতে-কলমে শেখার কাজ ভয়ানকভাবে অনুপস্থিত। 

যতদিন পর্যন্ত আমরা ভাষা, প্রতিবেশ, গণিতক ও জীবন দক্ষতা নিশ্চিত করতে পারব ততদিন আমাদের লক্ষ-কোটি টাকা শুধু জলে যাবে। এ বিশাল কর্মযজ্ঞে অনেক অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রথমত, ১ম-৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক, ৯ম-১২তম শ্রেণি মাধ্যমিক, ১৩তম-১৬তম শ্রেণি স্নাতক এবং ১৭তম-১৮তম শ্রেণি হবে মাস্টার্স। প্রাথমিক শিক্ষা হবে শিক্ষার বুনিয়াদ, বস ভিত্তি। ভাষা, অঙ্ক, পরিপার্শ্ব, সামাজিক বিজ্ঞান শেখানো হবে এ পর্বে।

মাধ্যমিক হবে জীবিকার জন্য শিক্ষা। মাধ্যমিক শিক্ষা অবশ্যই অভিন্ন, একমুখী ও কারিগরি দক্ষতাভিত্তিক হবে। বিদ্যমান উচ্চ মাধ্যমিক বিলুপ্ত করে উচ্চ পেশাভিত্তিক হবে স্নাতক পাঠক্রম। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, শিক্ষক, উকিল ইত্যাদি পেশাজীবীদের এই পর্বে দক্ষ করে হবে।

কেবল উচ্চ মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা মাস্টার্স করার সুযোগ পাবেন। তারা হবেন গবেষক, নীতি প্রণেতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পূর্ণ গবেষণাধর্মী হবে। নতুন জ্ঞান সৃজন হবে তাদের প্রধান দায়িত্ব। চলমান কেরানি ও অদক্ষ ডিগ্রিধারী এক দঙ্গল বেকার তৈরির কারখানা থেকে মুক্ত করে নতুন যুগের চাহিদানুযায়ী বিশেষজ্ঞ তৈরি তার জন্য কাজ করবে বিশ্ববিদ্যালয়। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কলা, ব্যবসায় ও মানবিক জ্ঞানচর্চার এই মহান প্রতিষ্ঠান হবে জ্ঞান সমন্বয়ের পীঠস্থান। বিশ্বের সাথে তার অহর্নিশ যোগাযোগ থাকবে, বিশ্ব জ্ঞানভাণ্ডার থেকে "নিব আর দিব, মিলাবো মিলিব" হবে দর্শন।

লেখক: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030660629272461