শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট সময়ের দাবি

এস এম হাবিব উল্লাহ (হিরু) |

আমি একজন শিক্ষক। এ পর্যন্ত আমি দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি। একটি চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, অন্যটি রাউজান সরকারি কলেজ। দুটি কলেজেই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল স্মার্টফোন ঠেকানো। শিক্ষার্থীর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হবে এই ভয়ে এই কঠিন কাজটি কোনো শিক্ষক খুব একটা আগ্রহ নিয়ে করতেন না। 

তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষক হয়েও প্রতিদিন আমাকে ক্লাসে স্মার্টফোন বিরোধী ওয়াজ করা লাগতো। ব্যাগ ও দেহ তল্লাশি করে প্রতিদিন মোবাইল ফোন উদ্ধার করা ছিল আমার নিত্যদিনের রুটিন কাজ।

চুয়েট কলেজে থাকতে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ঠিক আগে পরীক্ষার্থীদের একটা রুমে প্রবেশ করালাম। সবার হাতে একটা করে খাম ধরিয়ে দিলাম, বললাম খামের উপর সবার নাম, রোল, বাবার নাম, বাবার ফোন নাম্বার লিখ। অনেকে মনে মনে ভেবেছিল মনে হয় বৃত্তির টাকা পয়সা দিবে হয়তো। কিন্তু একটু পর তাদের ভুল ভাঙ্গলো। বললাম এইবার সবার পকেট, ব্যাগে হাত দিয়ে মোবাইলটা বের করো। ব্যাটারি ডিসকানেক্ট করে খামে পুরে মুখে আঠা লাগাও। প্রায় ১২০টা মোবাইল জব্দ করলাম। মোবাইলের স্তুপ পড়ে গেল। এইসব মোবাইল রাখার জন্য প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে একটা আলাদা আলমারি দিলেন। আইফোন থেকে শুরু করে সব ক্যাটাগরির ফোন ছিল। কলেজ ছুটির পর আমার চামড়া তোলে নেয়ার মিছিল হলো ক্ষুদ্র পরিসরে।

সন্ধ্যা নাগাদ অনেক অভিভাবক ফোন দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানালো। বললেন, যে কাজ আমরা গত ২ বছরে করতে পারিনি, তা আপনি আজকে করে দেখালেন। এক অভিভাবক রীতিমতো আমার বাসায় মিষ্টি পাঠিয়ে দিলেন! 

চুয়েট কলেজের শিক্ষার্থীরা হয়তো এই প্রথমবার আমাকে অপছন্দ করেছিল।  কিন্তু এই কাজটা করেছিলাম শিক্ষার্থীদের স্বার্থে এবং প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে। এই মোবাইল পরবর্তী ছয়মাস পর অভিভাবকদের হাতে ফেরত দেয়া হয়েছিল।

রাউজান কলেজ অনেক বড় কলেজ। এইরকম সাঁড়াশি অভিযান চালানোর সুযোগ পাইনি। তবু চেষ্টা করি ক্লাসরুমকে স্মার্টফোন মুক্ত রাখতে।  এই একটা কারণেই কলেজের শিক্ষার্থীদের বিশাল একটা অংশ আমাকে খুবই অপছন্দ করে। স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেট বিরোধী ওয়াজ-নসিহত এই কলেজেও রীতিমতো চালু আছে।

ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! করোনাকালে শিক্ষা এখন অনলাইনকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এখন উল্টো শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে হচ্ছে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্যে! 

করোনাকালে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এই উদ্যোগের সুফল সব শিক্ষার্থী নিতে পারছে কি না? সন্দেহ থেকে যায়। কারণ অনেকের হয়তো স্মার্ট ফোন, আবার অনেকের ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনার সামর্থ্য নেই। সম্প্রতি আবার ইন্টারনেট ডাটা প্যাকের মূল্য বাড়িয়েছে ফোন কোম্পানিগুলো। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এবং খেটে খাওয়া মানুষের সন্তানদের জীবন এখন সংকটাপন্ন। তাদের জন্যে সবগুলো ক্লাসে যুক্ত থাকার মতো ইন্টারনেট ক্রয় সত্যি কষ্টকর। তাই শিক্ষার্থীদের জন্যে ফ্রি-তে কিংবা স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট ডাটা সরবরাহ করা এখন সময়ের দাবি। 

শিক্ষা কখনোই বৈষম্যমূলক হওয়া উচিত নয়। গরিব ছেলেমেয়েরা যদি সুযোগ না নিতে পারে তাহলে অনলাইন ক্লাস চালানো তা হবে বৈষম্যের সামিল। তাই করোনাকালে ছাত্রছাত্রীদের জন্যে দিনের বেলায় সুলভে ইন্টারনেট ডাটা প্যাক দেয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি। 

শিক্ষকদের জন্য চাই না, শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের এই সুবিধার আওতায় আনা যায় কি না ভেবে দেখা দরকার। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনলাইন ক্লাসের জন্যে যাবতীয় উপকরণ যেমন-  হোয়াইট বোর্ড, মার্কার, ট্রাইপড, মাইক্রোফোন, লাইটিং সামগ্রী পকেটের টাকা খরচ করে কিনেছি। অবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেটের জন্য প্রতিমাসে ৪০ জিবি করে ডেটা প্যাক নিচ্ছি। আমার নিজের জন্যে কোনো দাবি নেই। কিন্তু প্রান্তিক ছেলেমেয়েদের প্রয়োজনের কথাটা যে আমাকে বলতেই হবে।

অনেকেই বলবেন, একজন রিকশাচালকের হাতেও আজকাল এনড্রয়েড মোবাইল আছে। নেট খরচে আর কয় টাকাই বা লাগে। দু-চারশ টাকা আজকাল কোনো টাকাই না। আমরা যারা মফঃস্বলে চাকরি করি তাঁরা জানি, অনেক ছেলেমেয়ে কত কষ্ট করে পড়ালেখা করে। ফরম পূরণের সময় এলে কষ্টের ডালি মেলে ধরে কত ছেলেমেয়ে। কত দুঃখ, কত কষ্ট তাদের। কত গরিব বাবার ছেলে মেয়েরা পরিবারের অনিচ্ছা স্বত্বেও পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে, তা আমরা কাছ থেকে দেখছি।

সরকারি নির্দেশনায় অনলাইন ক্লাস চালাচ্ছি। করোনাকালে অন লাইন ক্লাস চলছে, চলবে। কিন্তু সেই ক্লাসের সুবিধা সব ছেলেমেয়ে নিতে পারছে কি না সেটা নিয়ে মনে একটা খচখচানি থেকেই যাচ্ছে। অনেক পরিবারে মোবাইল এবং ইন্টারনেট কিনা নিয়ে মন কষাকষি চলাটাও অস্বাভাবিক নয়। 

লাইভ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি খুবই কম। কিছু শিক্ষার্থীর পরিবারে তো একটা স্মার্টফোন পর্যন্ত নেই। তারা ভার্চুয়াল ক্লাসের সুবিধা নিতে পারছে না। একটা বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষার ইনক্লুসিভ চরিত্রটা থাকছে না। এই বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের ফ্রি ডাটা প্রদানের জোর দাবি জানাচ্ছি। ফ্রি না হলেও সুলভ মূল্যে ডাটা দেয়া যায় কি না সেটি বিবেচনা করার অনুরোধ করছি।

লেখক : এস এম হাবিব উল্লাহ (হিরু), প্রভাষক, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, রাউজান সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0057029724121094