সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর সময় বলা হয়েছিল নোট-গাইড, কোচিং, গৃহশিক্ষক নির্ভরতা ও মুখস্থবিদ্যার বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কারিগর ও রূপকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যাধুনিক দেশ গড়া, স্বনির্ভর, উন্নত ও শতভাগ শিক্ষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অন্তরায় হচ্ছে নিম্নমানের গাইড বই।
মুখস্থবিদ্যা ও গাইড বই নির্ভরতার বদলে চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটানোই ছিল সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পেছনের কথা। কিন্তু বাজার যেখানে সৃজনশীল গাইড বইয়ের দখলে, সৃজনশীল পদ্ধতিই হুমকির মুখে পড়াটা স্বাভাবিক নয় কি?
সব শ্রেণির, সব বিষয়ের সৃজনশীল বিষয়ের গাইড বই পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। অভিভাবকেরা বুঝে কিংবা না বুঝেই এসব বই তুলে দিচ্ছেন ছেলে-মেয়েদের হাতে। ছাত্র-ছাত্রীরাও মননশীল চিন্তা ধারালো করার চেয়ে গাইড বইয়েই বেশি মনোযোগী। অথচ সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের একমাত্র সহায়ক হওয়ার কথা পাঠ্য বই। তাই এ বিষয়ে অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়া উচিত। শিক্ষকদের পাশাপাশি তাদেরও উচিত পাঠ্যবই ভালো করে পড়তে সন্তানদের উৎসাহিত করা।
তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ক্লাসে যারা শেখাবেন; সেই শিক্ষকদের বড় একটি অংশ সৃজনশীল পদ্ধতি পুরোপুরি বোঝেন না। স্কুল পরীক্ষার প্রশ্ন করতে তারা দ্বারস্থ হন গাইড বইয়ের। অনেক সময় কিছু শিক্ষক প্রশ্ন তুলে দেন গাইড বই থেকে। অনেক শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করেন গাইড বইয়ের নমুনা প্রশ্ন সামনে রেখে। মুখস্থনির্ভরতা কমিয়ে গাইড বই ও কোচিংয়ের সাহায্য ছাড়াই শিক্ষার্থীদের প্রতিভা, মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে সৃজনশীল মনন গড়ে তোলাই সৃজনশীল পদ্ধতির লক্ষ্য।
পাঠ্যবই ভালোভাবে পড়লে গাইড বইয়ের সাহায্য ছাড়াই সব প্রশ্নের উত্তর করা সম্ভব। তাৎপর্য বুঝে সৃজনশীল পদ্ধতিকে সবাই স্বাগত জানালেও এ পদ্ধতির জন্য বড় হুমকি বিভিন্ন নোট বা গাইড বই।
বেশির ভাগ বইয়ের দোকান বিভিন্ন প্রকাশনীর ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব বিষয়ের সৃজনশীল গাইড ও নোট বইয়ে ঠাসা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রণীত সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর সময় বলা হয়েছিল নোট-গাইড, কোচিং, গৃহশিক্ষক নির্ভরতা ও মুখস্থ বিদ্যার বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে। আদতে তা হয়নি।
সৃজনশীল ও বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্রের আলোকে রচিত ‘সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর সম্বলিত’, শতভাগ কমন পড়ার নিশ্চয়তা’, ‘সৃজনশীল সুপার সাজেশন’ বিভিন্ন গাইড বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠাতেই লেখা থাকে এমন সব চটকদার বিজ্ঞাপন।
স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে আগ্রহ কমে গেছে শিক্ষার্থীদের। তারা চাপিয়ে দেয়া অবৈধ নোট ও গাইড বই মুখস্থ করতেই ব্যস্ত। এ নিয়ে উদাসীন কর্তৃপক্ষ। নেই কোনো পদক্ষেপ।
জানা গেছে, অবৈধ নোট ও গাইড বই সারা দেশে ছড়িয়ে বিভিন্ন পাবলিকেশন্সসহ অনেক প্রতিষ্ঠান হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করছে। এর ভাগ পান সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরাও। ফলে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ হচ্ছে না। ধ্বংস হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। শিক্ষার নোট ও গাইড বইয়ের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ চান শিক্ষাবিদরা।
সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও কমেনি গাইড নির্ভরতা। ছাত্র-ছাত্রী তো বটেই, শিক্ষকরাও ঝুঁকছেন গাইড বইয়ে। ছাত্র-ছাত্রীরা সৃজনশীলে কাঁচা মেনে নেয়া যায়; কিন্তু সরকারিভাবে বারবার শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবার পরও বেশির ভাগ শিক্ষকই এ পদ্ধতি বোঝেন না, এটা মেনে নেয়া সত্যি অত্যন্ত কঠিন।
লেখক : সহকারী প্রধান শিক্ষক, রাজঘাট জাফরপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়,অভয়নগর, যশোর