শিক্ষায়তনে মেয়েদের স্যানিটেশন

সালাহ্‌ উদ্দিন নাগরী |

জ্ঞানচর্চা ও প্রতিভা বিকাশের কেন্দ্র হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ঘুমানোর সময়টুকু বাদ দিলে একজন শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাসায় প্রায় সমপরিমাণ সময় অতিবাহিত করে। সে জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গৃহপরিবেশ অত্যন্ত দরকার। যদি এমন ব্যবস্থা করে দেওয়া না যায় তাহলে সঙ্গত কারণেই সেখানে কেউ স্বস্তি পাবে না। আর অস্বস্তি নিয়ে জ্ঞানচর্চা ও প্রতিভার বিকাশ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ও শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন কারণে একজন মেয়ে বা মহিলাকে সারাদিনে পুরুষদের তুলনায় বেশিবার টয়লেট-বাথরুমে যেতে হয়। কিন্তু দেশের অধিকাংশ, প্রধানত মফস্বল অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বাসাবাড়িতে যথোপযুক্ত টয়লেটিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। 

আমাদের পাশ্ববর্তী দেশগুলোতেও স্যানিটেশন কার্যক্রম খুব একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। আমাদের গ্রাম এলাকায় একজন মেয়েকে যত সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে পড়ালেখা করতে হয়, একজন ছেলেকে তত কষ্ট স্বীকার করতে হয় না। আগে স্কুল-কলেজ যত দূরেই হোক, পড়ালেখা করতে চাইলে হেঁটে যাওয়ার বিকল্প ছিল না। এখন রিকশা, নছিমন, টেম্পোতে যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকলেও স্কুলের একজন মেয়ের পক্ষে এই পথ পাড়ি দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। হেঁটে, টেম্পো-নছিমনে ধস্তাধস্তি করে ওঠানামা, রাস্তাঘাটে ইভটিজারের উপদ্রব, রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরেই মেয়েদের পড়ালেখা করতে হচ্ছে। গ্রামের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে একটি মেয়ে যখন তার স্কুলে পৌঁছে, তখন প্রয়োজন থাকলেও টয়লেট/বাথরুমে যেতে পারে না। ফলে ক্লাসে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করা, শিক্ষকদের লেকচার ফলো করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

২০১৬ সালের তথ্য নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অ্যানুয়াল সেক্টর পারফরম্যান্স রিপোর্ট-২০১৭ মতে, ৬৭ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। ১৮ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটিও টয়লেট নেই। ৮১ দশমিক ৭ শতাংশ বিদ্যালয়ে কমপক্ষে একটি টয়লেট আছে, যা ছেলেমেয়ে উভয়ে ব্যবহার করে। অভিজ্ঞদের মতে, যে বিদ্যালয়ে মাত্র একটি টয়লেট আছে, তা শুধু ছাত্রীদের ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। স্কুলে টয়লেট, বাথরুম না থাকায় শিশুদের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও জাতীয় জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। 

অধিকাংশ স্কুল-কলেজে টয়লেটের অবস্থান এমন জায়গায়, শিক্ষক, দারোয়ান, দপ্তরি, কো-এডুকেশন হলে ছাত্ররা সহজেই দেখতে পায়, কে টয়লেটে ঢুকছে ও বের হচ্ছে। এতে ছাত্রীরা অস্বস্তি বোধ করে, টয়লেটে যেতেই চায় না। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে ছেলে ও মেয়েদের টয়লেট আলাদা জায়গায় তৈরি করতে হবে। মেয়েদের টয়লেট এমনভাবে বানাতে হবে, কে কখন টয়লেটে ঢুকছে তা যেন ছাত্র বা পুরুষদের নজরে না আসে। কোথাও কোথাও টয়লেট মূল বিল্ডিং থেকে দূরে হওয়ায় ঝড়-বৃষ্টিতে প্রয়োজন হলেও ছেলেমেয়েরা যেতে পারে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে কোনো প্রান্ত থেকে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে ছাউনির নিচ দিয়ে টয়লেট পর্যন্ত যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক প্রতিষ্ঠানের টয়লেট অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে, দুর্গন্ধযুক্ত। কোনো কোনো টয়লেটের দরজায় ছিটকিনি থাকে না। কেউ ভেতরে ঢুকলে বাইরে আরেকজনকে পাহারায় থাকতে হয়।

মফস্বলের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টয়লেটগুলোর সামনে টিউবওয়েল এবং বেশ কিছু বদনা এলোমেলো পড়ে থাকতে দেখা যায়। মেয়েদের টিউবওয়েল  চেপে বদনায় পানি নিয়ে টয়লেটে ঢুকতে হয়। এক  বদনা পানিতে নিজেকে ও প্যান-কমোড পরিস্কার করা সম্ভব হয় না। 

২০১৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেস লাইন সার্ভে অনুযায়ী, দেশে প্রতি ১৮৭ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মাত্র একটি টয়লেট। যার ৪৫ শতাংশ নানা কারণে বন্ধ থাকে। যেগুলো খোলা থাকে সেগুলোও সারাদিন পরিস্কার রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। দিনের শুরুতে একবার পরিস্কার করা টয়লেট দু-একজনের ব্যবহারের পরই আর ব্যবহারোপযোগী থাকে না। টয়লেটে মল-মূত্র ভাসে, ময়লা পানি উপচে পড়ে; সুইপারকে সারাদিন আর পাওয়া যায় না। এ ধরনের পরিস্থিতি বিবেচনায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টয়লেট ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নতকরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২৩/০৬/২০১৫ তারিখে ১১টি নির্দেশনা সংবলিত পরিপত্র জারি করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনাগুলো হলো- টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়টি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির নজরদারিতে আনতে হবে। টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য শিক্ষকদের নেতৃত্ব দিতে হবে। জেন্ডারবান্ধব স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে হবে।

নারীদের দেহের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রতি মাসে ঋতুস্র্রাব হয়। ৫-৭ দিনের এই ঋতুস্রাবের সময় শরীর দুর্বল ও মন খিটমিটে এবং রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির একজন মেয়ের কাছে এটি একেবারেই নতুন পরিস্থিতি। ওই সময় তাদের মধ্যে ভীতি ও আশঙ্কা বিরাজ করে। এ অবস্থায় একজন মেয়ে যখন স্কুলে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতাটুকু যথাযথভাবে সম্পন্ন করার পরিবেশ এবং উপকরণ না পায়, তখন সে বিশেষ কয়েক দিন স্কুলে যাওয়ার আগ্রহই হারিয়ে ফেলে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের ঋতুকালীন বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য একজন শিক্ষিকাকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিতে হবে। নারী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন, ৮৬ শতাংশ মেয়ে ঋতুস্র্রাবের সময় গড়ে ৩ দিন পর্যন্ত স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। 

প্রাইমারি স্কুলের ছেলেমেয়েরা অনেক সময় একা একা টয়লেট ব্যবহার করতে পারে না; নিজের কাপড়চোপড়, প্যান-কমোড নোংরা করে ফেলে। তাদেরকে সরেজমিন টয়লেট ব্যবহার, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পদ্ধতি বুঝিয়ে ও শিখিয়ে দিতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশে সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এ দায়িত্ব পালন করে থাকে। আমাদের দেশেও শিক্ষকদের এ পদ্ধতি অনুসরণের চেষ্টা করতে হবে। 

একজন মানুষের প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই লিটার পানি পান করা দরকার। শিক্ষা বা কর্মপ্রতিষ্ঠানে টয়লেট ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায়, অনেক মেয়েই প্রয়োজনের তুলনায় অল্প পানি পান করে। নারী শিক্ষার্থী, কর্মজীবী ও যাদের দীর্ঘ সময় বাসার বাইরে থাকতে হয়, তাদের 'ইউরিন ইনফেকশন' একটি কমন ডিজিজে পরিণত হয়েছে। আর এই 'ইউরিন ইনফেকশন' থেকেই কিডনিসহ বহুবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সর্ব্বোচ্চ ৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য নূ্যনপক্ষে একটি টয়লেটের ব্যবস্থা রাখলে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয়তা মোটামুটিভাবে পূরণ হবে। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য সার্বক্ষণিক সুইপার নিয়োগ ও সাপ্লাই পানির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে অন্যান্য খাত সংকুচিত করে এ খাতে অধিক বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখতে হবে। মফস্বলের স্কুল-কলেজের টয়লেটগুলো ক্যাম্পাসের এমন জায়গায় তৈরি হয়, অনেকের একা একা সেখানে যেতে গা ছমছম করে। ভুতুড়ে নয়, অনুকূল পরিবেশে টয়লেট নির্মাণ করতে হবে। 

এখন অনেক বাসায় টয়লেটে প্যানের বদলে কমোড ব্যবহার করা হয়। কমোডে অভ্যস্ত হয়ে গেলে প্যান ব্যবহারে সমস্যা হয়। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে  টয়লেটে কমোড না থাকলে অনেক শিক্ষার্থী  টয়লেটই ব্যবহার করতে চায় না। কমোড আর কোনো বিলাসিতা নয়। প্যানের মূল্যেই কমোড পাওয়া যায়। তাই প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের টয়লেটে প্যান ও কমোড উভয়েরই ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে একজন মানুষকে প্যান-কমোডযুক্ত উভয় প্রকার টয়লেট ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে হবে। অভিভাবকদের উচিত তাদের সন্তানদের শুধু কমোড নয়, প্যান ব্যবহারে তাদের অভ্যস্ত করে তোলা। 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টয়লেট ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নতকরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্বে উল্লিখিত পরিপত্রের ১১টি নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন, টয়লেট পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, পানি ও সাবানের ব্যবস্থা রাখা এবং ঋতুকালীন স্যানিটেশনের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধু কমিটি গঠন করলেই সব দায়িত্ব সম্পন্ন হয়ে গেল মনে করার কোনো কারণ নেই। বাস্তবে এর প্রয়োগ ঘটাতে হবে। ব্যবস্থাপনায় আমাদেরকে আরও বেশি সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতে হবে। মনে রাখা দরকার, ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি থাকলে অনেক ভালো উদ্যোগ ও কার্যক্রম ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। 

 

লেখক: সরকারি চাকরিজীবী


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027101039886475