শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর অভিভাবক কে?

সৈয়দ আবুল মকসুদ |

স্বাধীনতার পরে ও আশির দশকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝে মাঝে যাওয়া হতো। কোনো কাজের জন্য নয়, আড্ডা ও ঘুরে বেড়ানো। বন্ধুদের আন্তরিক আতিথেয়তা। নৈসর্গিক পরিবেশ মনোরম। অল্প সময়ের জন্য নয়, গেলে থাকতাম সকাল থেকে সন্ধ্যা। সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীরনগরের আবহ অন্য রকম। গাছপালা ঝোপঝাড় থেকে একধরনের মদির ঘ্রাণ মাদকতার সৃষ্টি করত। কত রকম পাখপাখালির কলকাকলি। তখন ঘনিষ্ঠদের মধ্যে ছিলেন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক, সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, নাট্যকলার সেলিম আল দীন, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের আজিজুল হক। আজ তাঁরা কেউ নেই। অপেক্ষাকৃত কম বয়সেই চারজন ভালো শিক্ষক, তার চেয়ে বড় কথা ভালো মানুষ, চলে গেছেন।

বন্ধু শামসুল হকের মাধ্যমেই আরজ আলী মাতুব্বরের সঙ্গে পরিচয়। এবং সেটা জাহাঙ্গীরনগরে এক অপরাহ্ণে। হাঁটতে হাঁটতে তাঁর সঙ্গে জীবন ও জগৎ নিয়ে অনেকক্ষণ কথা হয়। ড. আজিজুল হকের সঙ্গে আলোচনা হতো সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে। তখন সামরিক স্বৈরশাসকবিরোধী গণতন্ত্রের আন্দোলন চলছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-শিক্ষকদের সেই সরকার ব্যবহার করছিল। রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধঃপতন ঘটে। অধ্যাপক আজিজুল হক বিশেষ লেখালেখি করতেন না। ছাত্রদের তৈরি করতেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির তখন তিনি সভাপতি। কোথাও তাঁর একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। তাতে শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতি নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল। লেখাটির একটি কপি আমাকে তিনি পড়তে দিয়েছিলেন। লেখাটিতে গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল। এক জায়গায় তিনি বলেছিলেন:

‘...সুযোগ-সুবিধা বণ্টনে উপাচার্য বা ক্ষমতাসীন মহলের সদস্যরা প্রাধান্য পায়, ফাইলের গতির ধারা ও মাত্রা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির গোষ্ঠী-অন্তর্ভুক্তির (ক্ষমতাসীন/বিরোধী) ওপর নির্ভরশীল-এটি বর্তমানে “ওপেন সিক্রেট” ব্যাপার না হয়ে খোলামেলা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক স্বার্থে নয়, উপাচার্য ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীস্বার্থে বিধিবহির্ভূতভাবে কাজ করেছেন অথবা বিশেষ/জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন এমন নজির আছে (যেমন বিভাগ/সেন্টার/ইনস্টিটিউট খোলা এবং তাদের প্রধান নিয়োগ)-নিরপেক্ষ তদন্ত করলেই সত্য বেরিয়ে আসবে। দুর্ভাগ্য, ১৯৭২ সালের পর দেশের ৪-৫ জন উপাচার্য দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে কারাভোগ করেছেন। দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, এলাকাপ্রীতি, গোষ্ঠীপ্রীতি, দুঃশাসন ইত্যাদির ব্যাপারে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী কর্তৃক কয়েক দফা পুস্তিকা, প্রচারপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এর পরেও (দাবি সত্ত্বেও) তিনি পদত্যাগ করেননি। পদের মর্যাদার চেয়ে পদের লোভটি এখানে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এতে উপাচার্য পদটির সামাজিক মর্যাদার দারুণ অবনয়ন ঘটেছে।’

এসব কথা তিনি বলেছিলেন ৩০ বছর আগে। এই তিন দশকে অবস্থার উন্নতি হয়েছে নাকি অবনতি ঘটেছে, তা সংশ্লিষ্টরা বলতে পারবেন। সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন খবরের কাগজের পাঠকেরা। বিশ্ববিদ্যালয় কোনো সরকারি দপ্তর নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উপাচার্য কোনো সরকারি কর্মকর্তা নন, যদিও সরকারই তাঁকে নিয়োগ দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র, নতুন জ্ঞান সৃষ্টিরও জায়গা। গত পাঁচ শ বছরে পৃথিবীতে যত নতুন আবিষ্কার হয়েছে, তা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই। তার সুবিধা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষাভাষীনির্বিশেষে সব মানুষ ভোগ করছে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার ফলেই নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হয়েছে এবং নতুন আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক বিদগ্ধ ইতিহাসবিদ সালাউদ্দিন আহমদ ছিলেন উঁচু সংস্কৃতিমান মানুষ। দীর্ঘায়ু পেয়েছিলেন, কিন্তু আফসোস হয় আরও কয়েক বছর তাঁর বেঁচে থাকা উচিত ছিল। মারা যাওয়ার কয়েক বছর আগে থেকে তিনি বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের অবস্থা এবং তাঁদের সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেন। যেকোনো কারণেই হোক আমার মতো সাধারণ মানুষের সঙ্গে তা নিয়ে আলোচনা করতেন। অত্যন্ত পণ্ডিত মানুষ-শান্ত, মৃদুভাষী, কিন্তু যন্ত্রণায় ভুগতেন। ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে এলে অথবা তাঁর টিএসসির ঘরে তাঁর সঙ্গে আমার কথা হতো। দেশের শিক্ষিত বেকারদের সম্পর্কে তাঁর কিছু পরিকল্পনা ছিল, তা নিয়ে কাজ করতে তিনি আমাকেও অনুগ্রহ করে যুক্ত করেন।

সরকারের অনেক কাজ। যাঁরাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বের হবেন, সবাইকে চাকরি দেওয়া সরকারের সাধ্যের বাইরে। আধা সরকারি বা বেসরকারি চাকরির বাজারও পর্যাপ্ত নয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোবার পরে চাকরিবাকরি ও জীবিকার প্রত্যাশা অস্বাভাবিক নয়। বিশের দশকে বিশাল অখণ্ড বাংলার দুই অংশে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যেরা মনে করতেন, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অভিভাবক। তাই দেখা যায়, স্যার ফিলিপ হার্টগ হোন বা স্যার আশুতোষ মুখার্জি হোন, তাঁরা তাঁদের সমাবর্তন ভাষণে তাঁদের ছাত্ররা কোথায় কোথায় ভালো চাকরি পেল, তা উল্লেখ করে সন্তোষ প্রকাশ করতেন।

যাঁরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে বাপের টাকায় ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া থেকে একটা ডিগ্রি জোগাড় করেন এবং সেসব দেশে গিয়ে সেকেন্ড হোমে আরামে থাকেন, তাঁদের কথা আলাদা। তাঁরা পরম ভাগ্যবান-ভাগ্যবতী। তাঁদের বাইরে দেশের যে লাখ লাখ যুবক-যুবতী, তাঁরা বড়ই ভাগ্যবিড়ম্বিত। তাঁরা কেউ কৃষকের সন্তান, কেউ গ্রামের বাজারের ছোট দোকানদারের সন্তান, কেউ ছোটখাটো চাকরিজীবীর ছেলেমেয়ে। কেউ পড়ালেখা শেষ করতে গিয়ে পরিবারের শেষ সম্বল ধানের জমিটুকু বিক্রি করেছেন, কেউ সকাল-সন্ধ্যায় টিউশনি করে পড়ার খরচ জোগাড় করেছেন, কেউ চড়া সুদে কোথাও থেকে টাকা ধার করে বিশ্ববিদ্যালয় পার করেছেন। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোনের অনেক আশা। পাস করে রোজগার করবে। সবাই একটু ভালো থাকবে।

কোনো নির্বোধও বলবে না ছাত্রদের পাস করে বেরোলে তাঁকে চাকরি দেওয়ার দায়িত্ব উপাচার্যের। তাঁর প্রশাসনিক দায়িত্ব বিরাট, কিন্তু তার চেয়ে বেশি নৈতিক দায়িত্ব। উপাচার্য শুধু তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অভিভাবক নন, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর ছাত্রদেরও তিনি অভিভাবক। এই যে লাখ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক-স্নাতকোত্তর সনদ নিয়ে বেরোচ্ছেন, তাঁরা কী অবস্থায় আছেন, কী তাঁদের ভবিষ্যৎ, তাঁদের কোনো সমস্যা আছে কি না, থাকলে তা সমাধানের উপায় কী, তা নিয়ে মাথা ঘামানো একজন উপাচার্যের নৈতিক দায়িত্ব।

আজকাল সংবাদপত্রে দেখা যায়, উপাচার্যরা নিয়োগ পেয়েই নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়ার জন্য ব্যাকুল। পদ আছে ১২ টি, নিয়োগ দেওয়া হলো ১৭২ জনকে। এবং তাঁরা কারা? ছেলে, মেয়ে, ভাগনে, ভাগনি, ভাতিজা, শালীর ছেলেমেয়ে। রক্ত ও বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয় হওয়ার প্রয়োজন নেই, অন্য বিশেষ কারণে চাকরি হয়। কিন্তু ওদিকে লাখ লাখ তরুণ-তরুণী বেকার। তাঁদের কোনো অভিভাবক নেই। প্রবৃদ্ধি ৬ না ৭ শতাংশ, তা শুনে তাঁরা কী করবেন। উন্নয়নের গল্পেই-বা তাঁদের কী যায় আসে!

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিতরা সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ। দেশের ভালোমন্দ তাঁরা খুব ভালো বোঝেন। তাঁরা রাজনীতিসচেতন। সমাজ ও রাষ্ট্রের যেকোনো ব্যাপারে তাঁদের মতামতের মূল্য রয়েছে। দেশকে সমৃদ্ধ, সুখী ও শান্তিপূর্ণ করতে দুই কোটি তরুণ-তরুণীকে বাদ দিয়ে হবে না। সবাই জীবিকার জন্য দলীয় ক্যাডার হতে পারেন না। সৎ ও যোগ্যদের স্বাধীন জীবিকাই প্রত্যাশিত।

যেকোনো সমস্যা নিয়ে সমাজে সাময়িক উত্তেজনা দেখা দিতে পারে। সহজ পথ তার যৌক্তিক সমাধান। দমনমূলক নীতি ফলপ্রসূ হয় না। আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে শিক্ষিতদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিলে, জীবনের প্রতি হতাশা থেকে তরুণ-তরুণীরা পথভ্রষ্ট হতে পারেন। মাদকাসক্ত হতে পারেন। উগ্র রাজনীতিতে ঝুঁকতে পারেন। সে উগ্র রাজনীতি ধর্মীয় হতে পারে, হঠকারী বামও হতে পারে। পুলিশ যদি জানতে পারে অমুকে সন্ত্রাসী, তাকে দমন করতে পারে, জনারণ্যে মিশে থাকা সন্ত্রাসীকে কীভাবে দমন করা সম্ভব? উন্নত দেশগুলোও তা পারছে না। কোটি কোটি তরুণের আজ যখন কোনো অভিভাবক নেই, তখন তাঁদের সমস্যার সমাধান ও অসন্তোষ দূর করতে হবে রাষ্ট্রকেই।

লেখক ও গবেষক

সৌজন্যে: প্রথম আলো


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032570362091064