রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে কুখ্যাত মাদক কারবারি শীর্ষ মোহাম্মদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকার অভিযোগ উঠেছে। শীষ মোহাম্মদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই শিক্ষক এখন অনেকটা আড়ালে থাকার চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে তিনি শিক্ষা ছুটি নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। দৈনিক কালের কন্ঠের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ হয়েছে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রফিকুল ইসলাম।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এই শিক্ষক হলেন রুয়েটের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সিদ্ধার্থ সঙ্কর সাহা। তিনি রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বেও আছেন। সেই সঙ্গে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদেও রয়েছেন। জানা গেছে, তাঁর সূত্র ধরে শীষ মোহাম্মদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তা এবং মানিক হোসেন (টেন্ডার মানিক) নামের ছাত্রদলের এক নেতারও সখ্য গড়ে ওঠে। টেন্ডার মানিকের বিয়ের বরযাত্রীও হয়েছিলেন দল বেঁধে এঁরা সবাই। এ ছাড়া শীষ মোহাম্মদের সঙ্গে তাঁদের একাধিবার ভারত সফর, একাধিকবার কক্সবাজার ভ্রমণ, একসঙ্গে সুইমিং পুলে গোসল, রুয়েটে, রাজশাহী নগরীতে আড্ডা দেওয়ারও বেশ কিছু ছবি কালের কণ্ঠ’র হাতে এসেছে।
একজন শীর্ষ মাদক কারবারির সঙ্গে রুয়েটের শিক্ষকের এমন সখ্যের ছবি প্রকাশ হওয়ার পর প্রশাসনেও নাড়া পড়েছে। মাদক কারবারির সঙ্গে সিদ্ধার্থ সঙ্করের সখ্যের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সরকারের উচ্চ পর্যায়েও চিঠি দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৭ সেপ্টেম্বর ‘ভারতে পালানোর চেষ্টা করছে শীষ মোহাম্মদ’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী খবর প্রকাশ হয় কালের কণ্ঠে। এরপর তৎপর হয়ে ওঠে প্রশাসনসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ১ অক্টোবর রাজশাহী নগরীর একটি বাসা থেকে শীষ মোহাম্মদকে সাদা পোশাকধারী পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তবে প্রথম দিকে পুলিশ গ্রেপ্তারের বিষয়টি এড়িয়ে যায়। ৫ অক্টোবর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শীষ মোহাম্মদকে ৩ অক্টোবর বিপুল পরিমাণ মাদক ও অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মাদক কারবারি শীষ মোহাম্মদ গোদাগাড়ী থেকে পালিয়ে এসে রাজশাহী মহানগরীতে আস্তানা গাড়েন। এখানে বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল সম্পদের মালিক হন। এই অর্থ ঢেলে তিনি নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করতে থাকেন। রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। তিনি রুয়েটকেন্দ্রিক আলাদা আরেকটি বলয় গড়ে তোলেন। সেই বলয়ের প্রধান ছিলেন রুয়েটের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সিদ্ধার্থ সঙ্কর।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদক কারবারি শীষ মোহাম্মদের সঙ্গে এই শিক্ষক ছাড়াও আরো কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তা একাধিকবার ভারত সফর করেছেন, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের ‘টেন্ডার মানিকের’ বিয়ের দাওয়াতে অংশ নিয়েছেন, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন। এমনকি গোদাগাড়ী পৌর মেয়র মনিরুল ইসলাম বাবুর নির্বাচনী প্রচারণায়ও অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা।
গোদাগাড়ীজুড়ে মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর শীষ মোহাম্মদ নগরীর কাড়িরগঞ্জ এলাকার নিজ বাড়ি ছেড়ে সিদ্ধার্থের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সিদ্ধার্থ নিজের বিয়ের আগ পর্যন্ত শীষ মোহাম্মদকে নগরীর আলুপট্টি এলাকায় তাঁর বাড়িতেই আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাঁর বাড়িতে তাঁদের ভূরিভোজেরও বেশ কিছু ছবি কালের কণ্ঠ’র হাতে রয়েছে।
তবে এসব তথ্য নাকচ করে দিয়েছেন সিদ্ধার্থ সঙ্কর। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের সিনিয়রদের সঙ্গে তার (শীষ মোহাম্মদের) পরিচয় ছিল। আমার সঙ্গেও তার পরিচয় ছিল। তবে একসঙ্গে আমরা কোথাও যাইনি। আমার বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার তথ্যও সঠিক নয়। তবে ভারত সফরে গিয়ে আমরা নিউ মার্কেট এলাকায় একসঙ্গে চা খেয়েছিলাম। তাই বলে তার সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক আছে এটা ঠিক না।’
ওই সূত্রটি আরো জানায়, রুয়েটে ‘টেন্ডার মানিক’ হিসেবে পরিচিত ঠিকাদার মানিকের সঙ্গেও সখ্য গড়ে তোলেন শীষ মোহাম্মদ। সিদ্ধার্থ সঙ্করের মাধ্যমে শীষ মোহাম্মদের অর্থে মানিক বিভিন্ন টেন্ডারে অংশ নেওয়া থেকে শুরু করে প্রাথমিক কাজের জন্য অর্থ জোগান দিতেন। এরপর আরো কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে শীষ মোহাম্মদের। তাঁদেরসহ সবার পরিবার নিয়ে কক্সবাজার ভ্রমণেও যান শীষ মোহাম্মদ।
এদিকে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, আন্তর্জাতিক মাদক কারবারি শীষ মোহাম্মদের সঙ্গে সখ্যের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর সিদ্ধার্থ সঙ্করের বিষয়ে সরকারের উচ্চ মহলে চিঠি দেওয়াও হয়েছে। শিক্ষক হয়ে কিভাবে একজন শীর্ষ মাদক কারবারির সঙ্গে এতটা সখ্য গড়ে তুললেন সেটি খতিয়ে দেখতে চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কয়েকটি সংস্থা তাঁর বিষয়ে তথ্য জোগাড়ে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, শীষ মোহাম্মদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর ঘনিষ্ঠ রুয়েটের এই শিক্ষক এখন অনেকটাই আড়ালে থাকছেন। এমনকি দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন বলেও অনেকে সন্দেহ করছেন। তিনি এরই মধ্যে ভারতের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার জন্য আবেদন করেছেন।
শীষ মোহাম্মদসহ রুয়েট শিক্ষক সিদ্ধার্থ সঙ্করের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে গোদাগাড়ীর পৌর মেয়র মনিরুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘বিষয়টি আমার মনে পড়ছে না। তবে অনেকেই তো প্রচারণায় অংশ নিয়েছিল, এত দিন পরে কি তাদের কথা মনে থাকে?’