শেখার ক্ষমতাটা শাণিত রাখা বেশি জরুরি : মুহম্মদ জাফর ইকবাল

মুহম্মদ জাফর ইকবাল |

ছেলেবেলায় ঈদের পরদিন ঘুম থেকে উঠে কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগত! বইমেলা শেষ হওয়ার পর আমাদেরও ক'দিন থেকে কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে! এতদিন বিকেলবেলা হলেই মনে হতো, বইমেলায় গেলে কেমন হয়? যখনই সময় পেয়েছি, সুযোগ পেয়েছি বইমেলায় গিয়েছি। চারপাশে বইয়ের স্টল, সুন্দর সুন্দর বইয়ের প্যাভিলিয়ন, সেখানে থরে থরে বই সাজানো। বিশাল এলাকাজুড়ে বইমেলা, একটু পরপর বসার ব্যবস্থা। সময় কাটানোর জন্য এর চেয়ে মনোরম জায়গা আর কী হতে পারে! সমস্যা একটিই- বইমেলা পর্যন্ত পৌঁছাতে গিয়ে জীবন বের হয়ে যায়। ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম থেকে নির্মম বিষয় পৃথিবীতে মনে হয় আর কিছু নেই। এর ভেতরে আটকা পড়লে হঠাৎ মনে হতে থাকে, কেন আমি ঘর থেকে বের হতে গেলাম? বইমেলায় যেতে গিয়ে আমি তিন দিন দীর্ঘ পথ হেঁটে গিয়েছি। মাঝেমধ্যে মনে হয়, ঢাকা শহরে বাস-গাড়ি-টেম্পো তুলে দিয়ে সবাইকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় হেঁটে যেতে বাধ্য করলে কেমন হয়? এখন যে রকম অবস্থা, তার থেকে খারাপ হবে বলে মনে হয় না।

আমি যেহেতু শুধু বইয়ের পাঠক নই, একই সঙ্গে বইয়ের লেখকও বটে; তাই আমার বইমেলার অভিজ্ঞতা অন্যদের থেকে একটু ভিন্ন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে, একটা সময় ছিল যখন বইমেলায় গিয়ে বটতলায় বসে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অটোগ্রাফ দিয়েছি। সন্ধ্যাবেলায় বাসায় যাওয়ার সময় আবিস্কার করেছি অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাতের আঙুল চিপসে গিয়েছে! এখন আর সে রকম অবস্থা নেই। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এখন বইমেলায় যারা আসছে তারা বই কিনছে অনেক কম, অটোগ্রাফের চাপ নেই। তবে নতুন এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। সেটার নাম 'সেলফি'। যে দুই-চারজন বইয়ের পাঠক একটা বইয়ে লেখকের অটোগ্রাফ নিতে আসছে, তাদেরকে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে প্রায় ছিটকে ফেলে দিয়ে সেলফি শিকারিরা আক্রমণ করছে। (অটোগ্রাফ শিকারি বলে একটা শব্দ সাংবাদিকরা মাঝেমধ্যে ব্যবহার করেন। শব্দটা আমার একেবারেই পছন্দ না। যারা অটোগ্রাফ নেয় তারা খাঁটি পাঠক। তবে যারা সেলফি নেয়, তারা আক্ষরিক অর্থেই 'শিকারি')।

বইমেলায় পাঠকদের অটোগ্রাফ দিতে দিতে আমি কিছু তথ্য আবিস্কার করেছি। ছোট শিশুদের বেলায় পাঠকদের মাঝে ছেলে ও মেয়ের সংখ্যা প্রায় সমান সমান হলেও শিশুরা যখন বড় হয়ে কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণী হয়ে যায়, তখন সেখানে ছেলেদের সংখ্যা ভয়াবহভাবে কম! আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, এ দেশে ছেলেরা হয়তো বই পড়া ছেড়েই দিয়েছে। বিষয়টা যে শুধু বইমেলায় দেখেছি, তা নয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানেও আমি একই ব্যাপার দেখেছি। ছেলেরা বই পড়ছে না। বই পড়ছে শুধু মেয়েরা! বই পড়াটাকে আমি খুবই গুরুত্ব দিই। আমি মনে করি, বই না পড়া পর্যন্ত একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারে না।

২.

সারা পৃথিবীতেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং নামে একটা ভার্চুয়াল জগতের জন্ম হয়েছে এবং রক্ত-মাংসের অনেক মানুষ সেই ভার্চুয়াল জগতে বাস করে। তাদের সেই ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে বাস্তব জগতের সরাসরি যোগাযোগ নেই বলে আমি সেগুলো সম্পর্কে খুব ভালো জানি না। তবে বইমেলায় সাংবাদিকদের প্রশ্ন শুনে মনে হচ্ছে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কের এই ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে বইমেলার জগতের এক ধরনের সংঘাত তৈরি হয়েছে! একদিন একজন সাংবাদিক এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ফেসবুক সেলিব্রিটিদের লেখা বই হঠাৎ বেস্টসেলার হয়ে যাচ্ছে। সে সম্পর্কে আমার মতামত কী। সাংবাদিকদের প্রশ্ন শুনেই অনুমান করা যায়, তারা ঠিক কোন উত্তরটি শুনতে চান। তবে আমি সবসময় তাদের 'সঠিক' উত্তর দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারি না। এবারও মনে হলো, সেটাই ঘটেছে; তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি। আমি বলেছি, নেটওয়ার্ক সেলিব্রিটি হওয়ার কারণে একজনের লেখা বই যদি হঠাৎ বেস্টসেলার হয়ে যায়, তাতে সমস্যা কোথায়? সত্যি যদি বইটি ভালো হয়ে থাকে, তাহলে সেটি তো বেস্টসেলার হতেই পারে। আর যদি কোনো ধরনের হুজুগের কারণে এটা বেস্টসেলার হয়ে থাকে, তাহলে দুই-চার বছর পরে এমনিতেই কেউ আর সেই বই পড়বে না। এর মাঝে উত্তেজিত হওয়ার মতো তো আমি কিছু দেখি না। এ রকম ব্যাপার সারা পৃথিবীতেই ঘটছে; আমাদের দেশে ঘটতে আপত্তি কোথায়? (বইয়ের ব্যাপারে আরও একটা মজার ব্যাপার ঘটে। যে বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়, সেই বই-ই যে সবচেয়ে বেশি পড়া হয়, সেটি কিন্তু সবসময় সত্যি নয়। সালমান রুশদির 'স্যাটানিক ভার্সেস' বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর তার অসংখ্য কপি বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু বইটি পড়ে শেষ করেছিল অল্প কিছু পাঠক)। তবে আমি কিন্তু সোশ্যাল নেটওয়ার্কের ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে বইমেলার বাস্তব জগতের যোগাযোগকে একটা ইতিবাচক বিষয় হিসেবে দেখি।

৩.

বইমেলা নিয়ে ইদানীং সারাদেশে একটা চমৎকার ব্যাপার ঘটতে শুরু করেছে। সেটি হচ্ছে, বইমেলা এখন শুধু ঢাকা শহরের মাঝে আটকা পড়ে নেই- সারাদেশেই বইমেলা হচ্ছে। আমি চট্টগ্রামের বইমেলায় গিয়ে মুগ্ধ হয়ে এসেছি। বিশাল এলাকাজুড়ে অনেক বড় একটি বইমেলা। ঢাকা শহরের মতো এক মাসব্যাপী নয়; কিন্তু যথেষ্ট সময় নিয়ে বইমেলা। তবে সেখানে যে বিষয়টি আমাকে মুগ্ধ করেছে সেটি হচ্ছে, সাহিত্য-সংক্রান্ত একটি আলোচনা। দেশের ও দেশের বাইরের সাহিত্যিকদের নিয়ে সেই আলোচনাটি ছিল অসাধারণ। আলাদাভাবে যে বিষয়টি আমাকে হতবাক করেছে সেটি হচ্ছে, সেই আলোচনায় উপস্থিত বিশাল সংখ্যক দর্শক। এত দর্শক যে এত আগ্রহ নিয়ে এত দীর্ঘ সময় সাহিত্যের ওপর আলোচনা শুনতে পারে, সেটি আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না! চট্টগ্রামের এ বইমেলাটি দেখে আমার মনে হয়েছে, সারাদেশেই এ রকম বইমেলার আয়োজন করা সম্ভব। আমরা এখন খুব একটা জটিল সময়ে বসবাস করছি। যত বেশি মানুষকে আমরা বই পড়ায় আগ্রহী করতে পারব, ততই মঙ্গল। আর বই পড়াতে আগ্রহী করার জন্য বইমেলা থেকে ভালো উদ্যোগ আর কী হতে পারে!

৪.

বইমেলা নিয়ে কথা বললেই বইয়ের কথা চলে আসে। আর বইয়ের কথা বললেই বই পড়ার কথা চলে আসে। আমার নিজেকে অসাধারণ সৌভাগ্যবান মনে হয় যে, আমি জন্মের পর থেকে অসংখ্য বইয়ের ভেতর বড় হয়েছি। শৈশবের সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতি হচ্ছে বাসায় অসংখ্য বই। আমি বইয়ের শেলফ থেকে সেই বই নামিয়ে বসে বসে তার পৃষ্ঠা উল্টে ছবি দেখছি। এক একটি ছবি দেখে মাথার মাঝে রাজ্যের কল্পনা এসে ভিড় করছে। পড়তে শেখার আগেও বই নেড়েচেড়ে দেখেছি। পড়তে শেখার পর সম্পূর্ণ নতুন আরেকটা জগৎ চোখের সামনে খুলে গেছে। মনে হয়েছে, শুধু আমার জীবনটাই একমাত্র জীবন নয়। এর সঙ্গে আমি অনেকটি জীবনযাপন করছি; যত বইয়ের যত কাহিনি ততগুলো জীবন। তাই আমার বুকটা ধক করে ওঠে, যখন একজন কিশোর বা কিশোরী এসে আমাকে বলে, 'স্যার, আমার বাবা-মা আমাকে বই পড়তে দেয় না; আমি কী করব?' আমাদের দেশে একটি বিচিত্র অভিভাবক শ্রেণির জন্ম হয়েছে, যারা মনে করেন, লেখাপড়া মানে পরীক্ষা। তারা বিশ্বাস করেন, পরীক্ষায় ভালো মার্কস ছাড়া এই জীবনে ছেলেমেয়েদের আর কিছু পাওয়ার নেই। আমি কেমন করে তাদের বোঝাব, কোনো কিছু শেখা থেকে হাজার গুণ বেশি জরুরি শেখার ক্ষমতাটাকে শাণিত রাখা। (সে জন্য আমি প্রাইভেট আর কোচিং এত অপছন্দ করি। তারা একজন শিশু-কিশোরকে কিছু একটা হয়তো শেখায়। কিন্তু তার শেখার ক্ষমতাকে পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়। তারা নিজেরা কিছু একটা শিখতে পারবে- সেই আত্মবিশ্বাসটা তাদের আর থাকে না)। যে অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের কাছে পরীক্ষায় ভালো ফল করা ছাড়া আর কোনো কিছুই চান না, তারা জানেন না যে, তাদের ছেলেমেয়েদের কত বড় ক্ষতি করে যাচ্ছেন!

যে কোনো সময়ের তুলনায় এই মুহূর্তে বই পড়া সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সারা পৃথিবীতে মানুষের মহামূল্যবান মস্তিস্কটিকে তার উপযুক্ত কাজের জন্য প্রস্তুত না করে সেটিকে অকর্মণ্য করে তোলার বিশাল একটা ষড়যন্ত্র কাজ করে যাচ্ছে। পৃথিবীর অন্য দেশে যা কিছু হতে থাকুক, আমরা কি আমাদের ছেলেমেয়েদের অন্যভাবে বড় করতে পারি না, যেন তার সঙ্গে দেখা হলেই তাকে জিজ্ঞেস করতে পারি, 'তুমি এখন কী বই পড়ছ?' তখন সে যেন উজ্জ্বল মুখে একটা বইয়ের নাম বলতে পারে। শুধু তাই নয়, সে যেন হাসিমুখে বলে, 'এটা শেষ করেই আমি নতুন একটা বই পড়ব!' সে তখন তার পরবর্তী বইয়ের নাম বলবে এবং আমরা মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকব। এটি কি খুব বেশি কিছু চাওয়া হলো?

 

লেখক: ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039730072021484