রাজধানীর পুরান ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক ছাড়াও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স রয়েছে। ১৭টি বিষয়ে স্নাতক এবং ১৬টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়ানো হয়, যা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বিষয়ের দিক থেকে কোনো অংশেই কম নয়। শিক্ষার্থীর সংখ্যাও প্রতিবছর বাড়ছে, কিন্তু বাড়ছে না শিক্ষক আর শ্রেণিকক্ষ। এ দুই সমস্যাই চরম।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ১৭ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য সংযুক্তি মিলিয়ে আছেন ১০৯ জন শিক্ষক। শ্রেণিকক্ষ ৪২টি। সেই হিসাবে গড়ে ১৫৬ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন একজন শিক্ষক, ৪০৫ শিক্ষার্থীর জন্য একটি শ্রেণিকক্ষ। অথচ জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রতি ৩০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক থাকার কথা বলা হয়েছে। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গড়ে ১৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক থাকতে হবে। বুধবার (২৮ আগস্ট) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন ও মাসুদ রানা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এ কলেজের শিক্ষার্থীরা জানায়, শিক্ষক আর শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে নিয়মিত পাঠ কার্যক্রম হয় না। অনেক সময়ই শিক্ষক থাকলে শ্রেণিকক্ষ ফাঁকা পাওয়া যায় না। আবার শ্রেণিকক্ষ পাওয়া গেলে শিক্ষক থাকেন না। এতে করে পাঠক্রম কোনো রকমে শেষ করেই পরীক্ষায় বসতে হয়।
১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৯২৩ সালে কলেজে রূপান্তরিত হয়। গত সপ্তাহে সরেজমিনে গিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক সমস্যা নিয়েই চলছে কলেজটি। শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষের সংকট ছাড়াও সেশনজট ও পরিবহন সংকটের পাশাপাশি রয়েছে আবাসন সমস্যা। একটিমাত্র ছাত্রাবাস দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে বেদখলে।
গত ফেব্রুয়ারিতে বেশ কিছু দাবিতে মানববন্ধনও করে কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবিগুলো হলো—শহীদ শামসুল আলম ছাত্রাবাসকে পূর্ণাঙ্গ হল করা, আবাসন সংকট নিরসন, শিক্ষক সংকট নিরসন, একাডেমিক ভবন সম্প্রসারণ ও সব শিক্ষার্থীর জন্য পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করা।
জানা যায়, রসায়ন, গণিত, অর্থনীতি, বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ ১২টি বিভাগে রয়েছে চারটি করে শিক্ষকের পদ। তবে সংযুক্তি মিলিয়ে শিক্ষকের সংখ্যা কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্সের নিয়মিত পাঠদান করতে হিমশিম খেতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত অন্য কলেজের মতো কবি নজরুল সরকারি কলেজেও সেশনজট চরমে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে পাঁচটি ব্যাচ থাকার কথা থাকলেও আছে আট থেকে ৯টি। প্রায় প্রতিটি বর্ষেই নতুন ও পুরনো ব্যাচ রয়েছে। কলেজে একটি গ্রন্থাগার থাকলেও সেখানে পড়ার সুযোগ নেই শিক্ষার্থীদের।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জামাল হোসেন বলেন, ‘অনেক সময়ই শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একটি বর্ষের ক্লাস শেষ হলে আমাদের ঢুকতে হয়। এ ছাড়া প্রায়ই স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা থাকে। তখন আর ক্লাস হয় না। ফলে আমাদের সিলেবাস শেষ হয় না।’
কলেজে ছাত্র ও ছাত্রী উভয়েই পড়ালেখা করলেও বাথরুম-টয়লেটও অপ্রতুল। মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৪০ শতাংশই ছাত্রী। কমনরুমে গুটি কয়েক বাথরুমের ওপর সবাইকে নির্ভর করতে হয়। এ ছাড়া বর্তমানে পরিবহন সুবিধা বলতে বিআরটিসির দুটি ডাবল ডেকার বাস রয়েছে।
কলেজের একমাত্র আবাসিক হল শহীদ শামসুল আলম ছাত্রাবাস পুরান ঢাকার কাগজীতলায় অবস্থিত। ছাত্রাবাসটির বড় অংশই বেদখল হয়ে গেছে। দখলদারদের সঙ্গে সমঝোতা করে ৫০ জন শিক্ষার্থী সেখান থাকছে বলে জানা গেছে। কিন্তু ছাত্রাবাসটিও এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। কক্ষগুলো নোংরা ও স্যাঁতসেঁতে। দিনের বেলায়ও বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। আগে এই কলেজ চত্বরেই মুসলিম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ছিল। এখন প্রতিষ্ঠানটি আলাদা হয়ে গেছে। ওই চত্বরে থাকা মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের ডাফরিন ছাত্রাবাসটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। তাই কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা ডাফরিন হলটি কলেজের নামে বরাদ্দের দাবি জানিয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বায়েজীদ শিকদার বলেন, ‘আমাদের ছাত্রাবাসে সমস্যার কোনো শেষ নেই। এখানে থাকা, খাওয়া থেকে শুরু করে সবটাতেই সমস্যা। প্রায় সময়ই পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ থাকে না। তা ছাড়া দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় বৃষ্টি হলে কক্ষগুলো ভিজে থাকে, সহজে শুকায় না। বাধ্য হয়েই এমন গুমোট পরিবেশে থাকতে হয়।’
কয়েক বছর আগেও সরকার সমর্থক সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ছিল। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা কমে এসেছে। অভিযোগ ছিল, কলেজে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি হলে তাকে নির্দিষ্ট ফির বাইরে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা অতিরিক্ত দিতে হতো, যা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পকেটে যেত।
জানতে চাইলে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাওলাদার বলেন, ‘ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি কলেজের সুনাম ধরে রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও সেটা অব্যাহত থাকবে।’
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার বলেন, ‘আমাদের শিক্ষক সংকট রয়েছে। কলেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার পর কোর্স কারিকুলামে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষক কম। সরকারি কলেজে পদ সৃষ্টির জন্য সরকারকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। আমাদের কলেজে ১০ তলা ভবন নির্মাণের প্রকল্প পাস হয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে কাজ শুরু হবে। এই ভবন নির্মাণ হলে শ্রেণিকক্ষের সংকট অনেকটাই দূর হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে শহীদ শামসুল আলম ছাত্রাবাসটি উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি। এ ছাড়া আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে দুটি বাস কেনার অনুমতির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। এটা পাস হলেই নতুন বাস কিনব।’