সমাজ ব্যবস্থা মানুষের মূল্যবোধ জাগ্রত করে

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন |

জাপানি পুলিশ বিভাগে কর্মরত একজন ভিয়েতনামি অভিবাসী হা মিন থান তার এক স্বদেশি বন্ধুকে, ব্রাদার’ সম্বোধন করে লেখা যে  চিঠিটি ফেসবুকের’ মাধ্যমে  পৌঁছে যায় দেশবিদেশে অবস্থানরত লাখ লাখ মানুষের কাছে এবং চিঠিটি ভাইরাল’ হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে সারা পৃথিবী। সেই ঘটনাকে বিবেচনায় নিয়ে আজকের লেখা। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ জাপানের সেন্ডাই উপকূলে ৯ দশমিক ১ মাত্রার এক শক্তিশালী ভূমিকম্প হানা দেয়। ভূমিকম্পের সাথে আসে সুনামি। ভূমিকম্প ও সুনামি- এই দুই প্রাকৃতিক দুর্যোগের যৌথ আঘাতে ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার কমপ্লেক্সের ৬টি রিয়েক্টারের মধ্যে ৪টিই ভেঙ্গে পড়ে। ভূমিকম্প, সুনামি ও নিউক্লিয়ার মেল্টডাউনের ফলে ফুকুশিমার আশপাশের মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা এবং পরিবেশের ওপর নেমে আসে এক মারাত্মকও ঐতিহাসিক বিপর্যয়। চিঠিতে উল্লেখিত দুর্ঘটনা ও তৎপরবর্তী জনদুর্ভোগের বিস্তৃত ও হৃদয়স্পর্শী বিবরণ নিম্নরূপ।

হা মিন লিখেছেন, দুর্যোগের অব্যবহিত পরে দুর্গত মানুষের উদ্ধারকাজে তারা দৈনিক ২০ ঘণ্টা করে কাজ করেছেন। তারপরও তার কাছে মনে হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণতৎপরতা খুবই অপ্রতুল। মানুষ দিনের পর দিন সীমাহীন আতঙ্ক ও ভোগান্তির মধ্যে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে প্রতি মুহুর্তে বাঁচার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিল। উদ্ধার কাজের জন্য জরুরি সেবা ও মানুষের প্রয়োজনীয় সহায়তা সামগ্রী পর্যাপ্ত পরিমাণে ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছিল না। পানি ও বিদ্যুৎ ছিল না। এমনকি উদ্ধারকর্মীদের খাবার ফুরিয়ে আসছিল। এমন অবস্থায় তাদের দিন কেটেছে অনেক কষ্টে। এক দিন বেঁচে আছে, তো পরদিন থাকবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না কারোরই। সার্বিক অবস্থা ছিল এতোটাই করুণ এবং নাজুক! মানুষের লাশ ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে এমন হয়েছিল, চোখ খুললেই তিনি দেখতে পেতেন শুধু লাশ আর লাশ। চোখ বন্ধ করলেও চারদিকে দেখতেন লাশের মিছিল। তার অবস্থান এবং কর্মক্ষেত্র ছিল ফুকুশিমা থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে। উদ্ধার কাজের সময় একদিন তার সাথে দেখা হয়েছিল ভিয়েতনামি বংশোদ্ভূত এক আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ারের। তার নাম টোয়া। টোয়া, ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের কোনো এক রিয়েক্টারে কাজ করতেন। দুর্ঘটনায় তার শরীরের বিভিন্ন জায়গা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। পরিচয় পেয়েই হা মিন সাথে সাথে টোকিওর আমেরিকান অ্যাম্বেসিতে ফোন করেন। অ্যাম্বেসি কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিতে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে টোয়াকে নিকটবর্তী আমেরিকান মিলিটারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করে। সৈকত থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার ভেতরে থাকতেন এক জাপানি মহিলা। তার নাম নগোয়েন থি হুয়েন। তিনি ১১ জন ভিয়েতনামি মহিলার একটি গ্রুপের সাথে কাজ করতেন। সুনামির সময় থি হুয়েন যখন দৌড়ে পালাচ্ছিলেন তখন ভিয়েতনামি মহিলারাও প্রাণপনে তাকে অনুসরণ করছিল অনেক দূর পর্যন্ত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের ভাগ্যবিড়ম্বনা কারো জানা নেই। নিরাপদ স্থানে এসে থি হুয়েন যখন পেছন ফিরে তাকালেন, তখন আর কাউকে দেখতে পেলেন না। শত চেষ্টা করে সম্ভবত তারাও কেউ জীবন বাঁচাতে পারেনি। পানি, বিদ্যুত, জরুরি  চিকিৎসাসেবা ও খাবারের স্বল্পতার সাথে সাথে ঠাণ্ডার কারণে মানুষের কষ্ট বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ। খাদ্য-পানীয়ের সাথে শীতবস্ত্রের অভাবে মানুষ হয়ে উঠছিল দিশেহারা। এতো দুর্দিন ও দুর্দশার মধ্যেও জাপানিরা ধৈর্য্য এবং শৃঙ্খলার কোনো ব্যত্যয় ঘটায়নি। এরকম বিপদের সময়েও তাঁদের  আত্মসংবরণ, আত্মমর্যাদা, সহমর্মিতা ও আত্মত্যাগ দেখে হা মিন রীতিমত বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছিলেন!

তারপর হা মিন রচনা করেন তার চিঠির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত ৯ বছরের এক ক্ষুদ্র জাপানি বালকের অসাধারণ চরিত্র। চিঠিতে হা মিন তার নাম উল্লেখ করেননি, কিন্তু ছেলেটির করুণ কাহিনী, গভীর মানবতাবোধ ও চরম আত্মত্যাগের হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়ে তিনি বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছেন। হা মিন তার এই মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতার কথা নিম্নোক্তভাবে লিখেছেন। উদ্ধার কাজ চলাকালীন সময়ে এক দিন রাতে তিনি গিয়েছিলেন উপদ্রুত এলাকার এক  গ্রামার স্কুলে, যেখানে ওই অঞ্চলের আশ্রয়হীন শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছিল। সে দিন রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণ এবং খাদ্য বিতরণ করা হচ্ছিল। হা মিন ছিলেন ডিউটি অফিসার। ত্রাণ নিতে আসা শরণার্থীদের লাইন ছিল অনেক লম্বা। লাইনের একেবারে শেষমাথায় দাঁড়িয়েছিল ৯ বছরের এই বালকটি। তার গায়ে ছিল একটি টি সার্ট’ এবং পরনে হাফপ্যান্ট। ঠাণ্ডায় ছেলেটি থর থর করে কাঁপছিল। হা মিন তার কাছে গিয়ে নিজের গায়ের জ্যাকেটটি খুলে দিলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন তার মায়ের কথা। ছেলেটি বললো, তার বাড়ি একেবারে সাগর তীরে। তার মা এবং ছোট বোনের কথা  সে কিছুই জানে না।  সম্ভবত সুনামির ঢেউয়ে তারা দুজনই ভেসে গেছে সাগরের নোনা পানিতে। বলতে বলতে সে চোখের পানি মুছলো।

হা মিনকে সে আরো বললো, যখন ভূমিকম্প হানা দেয় তখন সে স্কুলে পি.ই. ক্লাসে ছিল। সুনামি আসার ঠিক আগে আগে ছেলেটি স্কুল বিল্ডিং এর তিন তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিল। তার বাবা স্কুলের খুব কাছেই কাজ করতেন। সুনামির খবর পেয়ে তিনি দ্রুত গাড়ি চালিয়ে তাকে নিতে স্কুলের দিকে আসছিলেন। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দেখছিল তার বাবার গাড়িখানা হঠাৎ ফুলে ওঠা  ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে উল্টে পাল্টে গিয়ে ডুবে গেলো ফেনায়িত সাগরের পানিতে। প্রকৃতির করাল গ্রাসে মাত্র ঘণ্টা খানেকের ব্যবধানে একটি বালক এক সাথে মা, বাবা ও বোনকে হারিয়ে এত বড় পৃথিবীতে একাই পথ চলার পথিক হিসেবে বেঁচে রইল। কী নির্মম ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা!

কীভাবে ছেলেটাকে সান্তনা দেবেন, হা মিন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এ দিকে বিতরণযোগ্য খাদ্য দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছিল। হা মিন আন্দাজ করলেন, লাইনের শেষে আসার আগেই খাবার মজুদ শেষ হয়ে যাবে। ছেলেটির ভাগ্যে কিছুই জুটবে না। মা-বাবা-বোনকে হারিয়ে অনাথ ছেলেটি সারা রাত উপোস করবে, হা মিনের তা সহ্য হচ্ছিল না। তিনি তার নিজের খাবার প্যাকেট ছেলেটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার কাছে আসতে আসতে সব শেষ হয়ে যাবে। তুমি এটা খাও, আমি খেয়েছি’। ছেলেটি প্যাকেট নিয়ে মাথা নামিয়ে জাপানি কায়দায় বাও ডাউন’ করে ধন্যবাদ দিলো এবং কিছুই না খেয়ে লাইনের সামনে গিয়ে ফুড বাস্কেট’ এর মধ্যে প্যাকেটটি রেখে দিয়ে লাইনের শেষে এসে আবার দাঁড়াল। হা মিন অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কিছুই না খেয়ে ওখানে নিয়ে প্যাকেটটি রেখে দিলে কেন? ছেলেটি বলল, আমার চেয়েও বেশি ক্ষুধার্থ কেউ আমার আগে থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন, তাই এটি আমার আগে তারই পাওয়া উচিৎ’।  হা মিনের মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে এলো। তিনি বললেন, যে সমাজ এবং শিক্ষা ব্যবস্থা একটি ৯ বছরের বালককে এমন উন্নতমানের মানবতাবোধ ও আত্মত্যাগ শিক্ষা দিতে পারে, সে সমাজের ক্ষয় নেই, সে জাতির পরাজয় নেই! বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে হা মিনের গল্প শুনে আমার মনে পড়ল। উন্নত বিশ্ব আর তৃতীয় বিশ্বে জীবনযাত্রার মান নির্ণয়ের এটিও একটি মানদণ্ড বটে! কোথায় তারা আর কোথায় আমরা!

লেখক : পরিচালক (গবেষণা ও তথ্যায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064570903778076