সমাপনী জুনিয়র পরীক্ষা এখনই বাতিল ঘোষণা করুন

আমিরুল আলম খান |

করোনা ভাইরাস সারা দুনিয়াকে স্তব্ধ করে ফেলেছে। মহা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন সারা দুনিয়ার মানুষ। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো পরিস্থিতি মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে। চীনের পর ইরান, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স এখন মৃত্যুপুরী। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা খুবই সঙ্গীন। এ পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে ৫১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত ১০ লাখের বেশি। দুর্বল অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য পরিষেবার বাংলাদেশের মানুষের তাই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার শেষ নেই।

বাংলাদেশসহ অধিকাংশ দেশেই চলছে লকডাউন। কোটি কোটি মানুষ ঘরবন্দি। দেশে গত ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। চলবে আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে লকডাউনের সময় বাড়াতে হতে পারে।

ভারতে লকডাউন চলবে তিন সপ্তাহ ধরে। অনেকের আশঙ্কা, ভারতে করোনা অতি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে এপ্রিলে। সেখানে করোনা এখন তৃতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ সামাজিক সংক্রমণ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত নাকি পরিস্থিতির অতটা অবনতি ঘটেনি। না ঘটলেই ভালো।

আমরা দেশের শিশু থেকে তরুণদের শিক্ষা নিয়ে চিন্তিত। আগামী ৯ এপ্রিল শবে বরাত। তার ১৫ দিন পর রমজান শুরু। সাধারণত, এদেশে রমজান মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লম্বা ছুটি থাকে। গত কয়েকবছরে এই ধারা চালছে। এবার তার সাথে যুক্ত হতে পারে গ্রীষ্মের ছুটি। সব মিলিয়ে আগামি বর্ষা মৌসুমের আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধছে। কেউ জানি না, করোনা কোন দিকে মোড় নেবে, কোথায় গিয়ে থামবে। কত জীবন কেড়ে নেবে। গোটা বিশ্বব্যবস্থায় কী ধরনের পরিবর্তন ঘটাবে।

আমাদের শিশুদের ঘাড়ে বইয়ের বোঝা। যদিও এ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। তার ওপর পরীক্ষার জগদ্দল পাথর। আমাদের সন্তানদের আনন্দ বিনোদনের সামান্য সুযোগটুকু পর্যন্ত নেই। ক্লাসে পড়ার চাপ, বাড়িতে পড়ার চাপ, কোচিং সেন্টারে ছুটাছুটির চাপে নাজেহাল তারা। পরীক্ষা হাজির হয় সাক্ষাৎ দৈত্য হয়ে। প্রাথমিক সমাপনী, জুনিয়র সার্টিফিকেট, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক —এই চারটে পাবলিক পরীক্ষা তাদের দিতে হয় যখন তাদের গড় বয়স যথাক্রমে ১১, ১৪, ১৬ এবং ১৮ বছর। সেখানে আবার জিপিএফাইভের চাপ, সোনালি গ্রেডের চাপ। তারপর থাকে ভর্তির সংকট, থাকা-খাওয়ার সংকট। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা শিশু বা শিক্ষার্থী বান্ধব নয় মোটেই। উপবৃত্তি, বিনামূল্যে সব নতুন বইসহ সরকার অনেককিছু দিয়েছে। তবু সমালোচনার অন্ত নেই। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাবিদ সকলেই চান এ অবস্থার অবসান। কিন্তু গত এক দশকে আমরা এসবের কোনও চূড়ান্ত মীমাংসা করতে পারিনি।

আমাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা অত্যন্ত দুর্বল, অর্থনীতি ভঙ্গুর। প্রকৃতি বৈরী উন্নয়নের দর্শন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংকট প্রবল। দেশের ৮০ ভাগ মানুষই নিম্ন মধ্যবিত্ত বা গরিব। তাদের ৫০ ভাগই দিন আনে দিন খায়। তাদের আয়-রোজগারের নিয়মিত উৎস নেই। গার্মেন্টস বন্ধ, বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের অবস্থা সঙ্গীন। ছোট ছোট ব্যবসা বন্ধ। চাকরিজীবীদের ভবিষ্যৎ অজানা। রিক্সা, ভ্যান, অটো, লেগুনা, বাস-ট্রাক শ্রমিকদের কোনো কাজ নেই, উপার্জন নেই। হাট, বাজার, ঘাট, হোটেল, দোকারেন অধিাকংশই বন্ধ। গৃহ পরিচারিকাদের বিদায় দেয়া হয়েছে আরও এক সপ্তাহ আগেই। হাসপাতাল, ক্লিনিকের অবস্থাও একই রকম। কাজেই যারা কোন রকমে বেঁচে থাকে তাদের সামনে শুধুই অন্ধকার। ছেলেমেয়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাবার নিয়ে মানুষ এখন উদ্ভ্রান্ত।

আমাদের কিছু জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় উপস্থিত বলে আমার বিশ্বাস। আমি মনে করি, শিশুদের ওপর পড়ার চাপ  ও মানসিক চাপ কমাতেই হবে। পরীক্ষার চাপ কমাতেই হবে। এবং সে সব সিদ্ধান্ত যত দ্রুত ঘোষণা করা যায় ততই ভালো। এখন যেটি বেশি দরকার তা হল, শিশুদের মানসিক চাপ কমানোর ব্যবস্থা নেয়া। মিডিয়ায় মনঃচিকিতসকদের বিভিন্ন লেখা আমরা প্রতিদিনই শুনছি, পড়ছি। সেসব কথা আমলে নেয়া জরুরি। এ বিষয়ে মনোচিকিতসকদের পরামর্শ শোনা বেশি দরকার। 

একজন শিক্ষক হিসেবে আমার পরামর্শ হবে, এখুনি প্রাথমিক সমাপনী ও জুনিয়র সার্টিকেট পরীক্ষাব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করা হোক। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য আগের মতোই স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার এখনই সময়। তাতে আমাদের আগামী প্রজন্ম এক প্রবল মানসিক বৈকল্য থেকে রক্ষা পাবে। শুধু তাই নয়, অভিভাবকদের ঘাড় থেকেও একটা বড় বোঝা নেমে যাবে। দুঃশ্চিন্তা কমবে।

সরকার বলতে পারে, আমরা পরীক্ষার ফি মাফ করে দেব। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়। ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা দেয়াতে অভিভাবকদের প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়। কিছু অভিভাবকেরও সমস্যা রয়েছে। অহেতুক প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হন। সেটা শুধু পরীক্ষার ফি নয়। আনুসঙ্গিক অনেক খরচ হয় তাদের। এমনিতেই করোনা আমাদের অর্থনীতির ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করেছে, ভবিষ্যতে সে চাপ আরও বাড়বে। অভিভাবকদের প্রচুর মানসিক চাপ সইতে হয়। সেসব থেকে সকলের মুক্তি দেবার এখনই উপযুক্ত সময়।

আমাদের একটা বদ অভ্যাস, আমরা শেষ সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিই, ঘোষণা করি। তাতে মহৎ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। কিছুই অর্জিত হয় না। তাই যা ন্যায্য, যা কাঙ্ক্ষিত তা যত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, যত দ্রুত ঘোষণা করা যায় ততই মঙ্গল।

লেখক : আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।

ইমেইল: [email protected]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0057289600372314