সরকারি স্কুলের শিক্ষক সংকট নিরসনের দাবিতে মানববন্ধন

বাগেরহাট প্রতিনিধি |

শিক্ষক সংকটের কারণে বাগেরহাটের দুটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম বছরের পর বছর ধরে বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জেলার মেধাবী শিক্ষার্থীরা এ দুটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলেও চাহিদার প্রায় অর্ধেক শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় আশানুরূপ ফলাফল করতে পারছেন না।

শিক্ষক সংকট নিরসনের দাবিতে মানববন্ধন | ছবি : সংগৃহীত

বিভিন্ন সূত্র জানায়, জেলা শহরে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সারা বছর জুড়ে প্রস্তুতি চলে শিক্ষার্থীদের। ছেলে-মেয়েদের সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অভিভাবকদের চেষ্টার যেন শেষ থাকে না। প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধাবীরা ভালো ফলাফল করার পর বাগেরহাট সরকারি বালক এবং সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। কিন্তু শিক্ষক সংকটের কারণে ভর্তির পর ওই বিদ্যালয় দুটিতে লেখাপাড়া আর পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকদের। চাহিদার প্রায় অর্ধেক শিক্ষককের পদ শূন্য থাকায় ওই দুটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন।

বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কোনো কোনো শ্রেণিকক্ষে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছে। আবার শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা হইহুল্লা করছে। টিফিনের সময় বিদ্যালয়ের মাঠে খেলাধুলায় ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা।

প্রভাতী এবং দিবা শাখার শিক্ষার্থীর সাথে দেখা মিলেছে বিদ্যালয় দুটিতে। এই প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে শিক্ষার্থীরা ছুটে এসে জানায়, শিক্ষক সংকটের কারণে তারা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল করতে পারছে না।

সরকারি এই বিদ্যালয় দুটিতে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত চালু রয়েছে। দুই শিফটে বিদ্যালয় দুটিতে তিন হাজার ৬৬০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। বিদ্যালয় দুটিতে ১০৬ জন শিক্ষকের পদ থাকলেও বর্তমানে ৬০ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। দীর্ঘদিন ধরে ৪৬ জন শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। এরপর নানা কারণে ছুটি,অসুস্থতা এবং বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার কারণে বিদ্যালয়ে প্রায়ই এক থেকে দুই জন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকে।

বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকায় এক বিভাগের শিক্ষককে অন্য বিষয়ের উপর পাঠদান করাতে হচ্ছে। আর হিন্দু ধর্মের শিক্ষকের কোনো পদ নেই। প্রায় ৭০০ জন হিন্দু শিক্ষার্থীকে অন্য বিষয়ের হিন্দু শিক্ষকরা পাঠদান করাচ্ছেন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। শিক্ষক সংকট নিরসনের দাবিতে অভিভাবক ফোরামের আয়োজনে বুধবার বাগেরহাট প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়।

বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় | ছবি : সংগৃহীত

২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাঁচ বছরে এসএসসি এবং জেএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রায় প্রতি বছরই অকৃতকার্যের তালিকায় আছে ওই বিদ্যালয় দুটি। আর জিপিএ-৫ (এ প্লাস) প্রাপ্তির সংখ্যাও আশানুরূপ নয়। এরইমধ্যে শতবছর পার করেছে বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং ৭০ বছর পার করেছে বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।

বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের তথ্য মতে, সহকারী প্রধান শিক্ষকের দুটি পদের দুটিই শূন্য রয়েছে। বাংলা বিভাগের পাঁচজন, ইংরেজির তিনজন, গণিতের তিনজন, ভৌতবিজ্ঞানের তিনজন, সামাজিক বিজ্ঞানের তিনজন, জীববিজ্ঞানের দুইজন, ইসলাম শিক্ষা বিভাগের দুইজন, কৃষিশিক্ষা বিভাগের দুইজন এবং চারু ও কারুকলা বিভাগের একজন শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে।

বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের তথ্য মতে, সহকারী প্রধান শিক্ষককের দুইজনের পদের মধ্যে একজন, বাংলা বিভাগের পাঁচজন, ইংরেজির দুইজন, গণিতের দুইজন, ইসলাম ধর্মের একজন, ভৌতবিজ্ঞানের দুইজন, জীববিজ্ঞানের দুইজন, ভূগোলের একজন, ব্যবসায় শিক্ষার দুইজন এবং কৃষি শিক্ষার একজন শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে।

সরকারি বিদ্যালয় দুটির অভিভাবক ফোরামের আহ্বায়ক আহাদ উদ্দিন হায়দার বলেন, বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বালিকা এবং বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে শিক্ষক সংকট চরমে। সংকট এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বিদ্যালয় দুটিতে দুই সেকশনের ক্লাস নিতে হচ্ছে একসাথে। ১০০ শিক্ষার্থীকে এক সাথে করে ক্লাস নেয়া হচ্ছে। মাঝে মধ্যে ক্লাস হচ্ছে না। বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক নেই। বাধ্য হয়ে দুটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা মিলে শিক্ষক ফোরাম গঠন করা হয়েছে। সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা কাজ করছি।

আসমাতুল ফাতিমা, সাদিয়া আফরোজ এবং অ্যাডভোকেট শেখ আবু জাফরসহ বেশ কয়েকজন অভিভাবকের সাথে কথা হলে তারা বলেন, তাদের ছেলে-মেয়েরা সরকারি বিদ্যালয় দুটিতে পড়ালেখা করছে। কিন্তু শিক্ষক সংকটের কারণে বিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা বিঘ্নিত হচ্ছে। বাধ্য হয়ে তারা প্রাইভেট শিক্ষক এবং কোচিং সেন্টারে ঝুঁকছে। এ কারণে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা করাতে তাদের অতিরিক্ত অর্থব্যয় করতে হচ্ছে। অনেকে প্রাইভেট শিক্ষক আর কোচিংয়ের ব্যয় মিটাতে হিমশিম খাচ্ছে।

অভিভাবকরা আরও বলেন, বিদ্যালয় দুটিতে এভাবে শিক্ষক সংকট চলতে থাকলে বাধ্য হয়ে তাদের ছেলে-মেয়েদের অন্যত্র নিতে হবে। তারা দ্রুত শিক্ষক সংকট নিরসনের দাবি জানান।

বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী সায়লা ইসলাম রিপা জানায়, তাদের বিদ্যালয়ে মাত্র ২৬ জন শিক্ষক দিয়ে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থীর ক্লাস নেয়া হচ্ছে। মানবিক এবং বিজ্ঞান বিভাগের ১২৬ জন শিক্ষার্থীকে এক সঙ্গে বসিয়ে একজন শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন। ৪৫ মিনিটের সময়ে ক্লাসে শিক্ষক ঠিকমত ছাত্রীদের কথা শুনতে পারে না। ঘণ্টা পড়লে পাঠদান না করিয়ে শিক্ষক ক্লাস থেকে চলে যান।

বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন বিশ্বাস জানান, ‘বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজার ৮৬০ জন। বিদ্যালয়ে ৫৩ জন শিক্ষককের পদ থাকলেও বর্তমানে ২৭ জন কর্মরত আছেন। ২৬ জন শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এছাড়া বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকায় এক বিভাগের শিক্ষক দিয়ে অন্য বিভাগের ক্লাস নেয়া হচ্ছে। আর বিদ্যালয়ে হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষকের কোনো পদ নেই।’

প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন বিশ্বাস আরও  জানান, ‘শিক্ষকের অধিক সংখ্যক পদ শূন্য থাকায় শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ব্যহত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা আশানুরূপ শিক্ষা পাচ্ছে না। বিদ্যালয় পরীক্ষার ফলাফল কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না।’

বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তপন কুমার বিশ্বাস জানান, বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজার ৮০০ জন। এই বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৫৩ জন শিক্ষকের পদ থাকলেও ৩৩ জন কর্মরত আছেন। ২০ জন শিক্ষকের পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক না থাকায় আরও বেশি সমস্যা হচ্ছে। হিন্দু ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষকের কোন পদ নেই বিদ্যালয়ে। প্রায় সাড়ে ৩০০ হিন্দু শিক্ষার্থীকে অন্য বিভাগের হিন্দু শিক্ষক দিয়ে ক্লাস নেয়া হচ্ছে। এরপর নানা কারণে ছুটি, অসুস্থতা এবং বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার কারণে বিদ্যালয়ে প্রায়ই এক থেকে দুইজন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকে। বিদ্যালয় দুটির প্রধান শিক্ষকগণ শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবার লিখিতভাবে জানালেও কোন ফল হয়নি।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক ও সরকারি বিদ্যালয় দুটি পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. মামুনুর রশীদ জানান, ‘শিক্ষক সংকটের বিষয়ে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করা হয়েছে। বাস্তবতার আলোকে শিক্ষক সংকট নিরসন করে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

তিনি আরও  জানান, ‘শিক্ষক সংকটের বিষয়টি মন্ত্রণালয় পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট কারণ বলতে পারবে। মাঠ পর্যায়ে নির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল। বিদ্যালয়ে হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষকের পদের বিষয়টি পদ সৃজনের সাথে জড়িত ।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004723072052002