সরকারিকৃত শতাধিক কলেজ অধ্যক্ষের যোগ্যতায় ঘাটতি নিয়োগে অনিয়ম

নিজস্ব প্রতিবেদক |

সদ্য সরকারিকৃত শতাধিক কলেজ অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষদের শিক্ষাগত যোগ্যতায় ঘাটতি ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম রয়েছে মর্মে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ সরকারি করার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সম্প্রতি ২৯৯টি কলেজ সরকারিকরণ করে সরকার। তবে এ কলেজগুলোর  মধ্যে শতাধিক অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও শিক্ষক পদে কর্মরতদের নিয়োগকালীন কাম্য যোগ্যতা নেই। 

জানা যায়, গত বছর টাঙ্গাইল জেলার আটটি কলেজ সরকারি করা হয়। এ কলেজগুলোর মধ্যে তিনটি কলেজের অধ্যক্ষ পদ শূন্য। উপাধ্যক্ষ নেই দুইটি কলেজে। অভিযোগ উঠেছে, গোপালপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. আনোয়ারুল ইসলাম আকন্দ প্রভাষক থেকে সরাসরি অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পরীক্ষার সময় গোপালপুর সরকারি কলেজে ৩ জন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কর্মরত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কলেজের সমাজকর্ম বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক ভদ্র বাবু অবসরে যাওয়ার পড়েও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরীক্ষায় প্রভাষক থেকে সরাসরি অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান মো. আনোয়ারুল ইসলাম আকন্দ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, নিয়োগের সময় বিধিমতে প্রভাষক পদ থেকে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসহ অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পাওয়ার বিধান ছিল। সে প্রেক্ষিতে আমি নিয়োগ পেয়েছি। আর নিয়োগের সময় একাধিক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিল অভিযোগটি সঠিক নয়। আমার নিয়োগের সময় একজন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কলেজে কর্মরত ছিলেন। 

অভিযোগে জানা যায়, মানিকুজ্জামান একই কলেজের ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে অযোগ্য বিবেচিত হলেও কিছুদিন পর উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পান। তৃতীয় বিভাগে অনার্স পাস করেন মানিকুজ্জামান। মাদরাসায় প্রভাষক পদে অভিজ্ঞতা দেখিয়ে উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। তবে অভিযোগ উঠেছে, মাদরাসার অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে কলেজে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি, যা বিধি বহির্ভূত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপাধ্যক্ষ মানিকুজ্জমান দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, আমি উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে আবেদন করার আগে প্রভাষক পদে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করি। কিন্তু যে কোনো কারণে নিয়োগ পাইনি। পরে প্রভাষক পদে শিক্ষকতার মেয়াদ ১২ বছর হলে আমি কলেজটিতে উপাধ্যক্ষ পদে আবেদন করি এবং নিয়োগ পাই। নিয়োগের সময়ের বিধিমতে তা যথার্থ ছিল। 

জানা যায়, জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার এ কে মেমোরিয়াল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হারুন-অর-রশিদ পূর্বের চাকরির ধারাকাহিকতা না থাকার পরেও উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, পূর্বে তিনি চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। তিন বছর তার বেতন-ভাতা বন্ধ ছিল। ওই তথ্য গোপন করে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হারুন-অর-রশিদ দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, ‘আমি এ কলেজেই চাকরি শুরু করি ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে। বিগত বিএনপি শাসনামলে আমাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আমি আদালতে গেলে আদালত আমাকে চাকরিতে বহাল করেন এবং বরখাস্তের সময় চাকরিকাল হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আদেশ দেন।’ আদালতে সব কাগজ তার হাতে রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।        

অপর অভিযোগে জানা যায়, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী সরকারি কলেজে ডিগ্রি পাস কোর্স ও শিক্ষাজীবনে একটি তৃতীয় বিভাগধারী আক্তারুজ্জামানকে উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে যা অবৈধ। তবে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে ধনবাড়ী সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ আক্তারুজ্জামান দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে আমি নিয়োগ পেয়েছি। নিয়োগের সময় ডিগ্রি পাস কোর্স ও একটি ৩য় বিভাগ নিয়ে নিয়োগ পাওয়ার বিধান ছিল। সে প্রেক্ষিতেই আমি নিয়োগ পেয়েছি। 

অপরদিকে, টাঙ্গাইলে কালিহাতির উপজেলার এলেঙ্গা এলাকার শামছুল হক কলেজের অধ্যক্ষ আনোয়ারুল কবীর এ কলেজে চাকরি নেয়ার আগে একটি কারিগরি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কোনো যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও মো. আনোয়ারুল কবীরকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে বলেও জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমতে ডিগ্রি কলেজের অভিজ্ঞতা কলেজে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগের জন্য বিবেচিত হবে। অপরদিকে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে জারি করা এমপিও নীতিমালায় বলা হয় কলেজে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নিয়োগের অভিজ্ঞতা হিসেবে বিবেচ্য হবে। সে প্রেক্ষিতে আমি নিয়োগ পেয়েছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত সে মামলা গড়ায়। সে মামলা জিতে আমি অধ্যক্ষ পদে যোগদান করি। 

গাজীপুর জেলার শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী কলেজের অধ্যক্ষ নুরুন্নবী আকন্দের একাধিক বিষয়ে তৃতীয় বিভাগ রয়েছে। তিনি নিয়মিত অধ্যক্ষকে বরখাস্ত করে নিজেই অধ্যক্ষ হয়েছেন। তবে, অভিযোগ বিষয়ে জানতে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে নুরুন্নবী আকন্দ ফোন কেটে দেন। পরবর্তীকালে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও ফোন রিসিভ করেননি নূরন্নবী আকন্দ। 

সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা কলেজের অধ্যক্ষ শামসুল ইসলাম ডিগ্রি পাস কোর্স কম্পার্টমেন্টালে পাসসহ স্নাতকোত্তর পাস। তবে, অধ্যক্ষ শামসুল ইসলাম দাবি করেন ডিগ্রি পাস কোর্স কম্পার্টমেন্টালে পাস করে চাকরি করা বিধি সম্মত। সে প্রেক্ষিতে আমি চাকরি করছি। 

লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী কলেজের অধ্যক্ষ আজিজার রহমান কোনো পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করেই তৈরি করা ফলাফল শিট দিয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। 

জামালপুর জেলার ইসলামপুর কলেজের উপাধ্যক্ষ ক্ষমতার জোরে নিয়মিত অধ্যক্ষকে বরখাস্ত করে অধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগ পেলেও একাডেমিক যোগ্যতার ঘাটতি থাকায় এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষের শিক্ষাজীবনে একাধিক বিষয়ে তৃতীয় বিভাগ রয়েছে। পরিদর্শনের পর উনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ অর্জন করেছেন। 

মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া ডিগ্রি কলেজ, কমলগঞ্জ গণ মহাবিদ্যালয় এবং তৈয়বুন্নেছা খানম একাডেমি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ তৃতীয় বিভাগসহ পাস কোর্সে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। সিলেট জেলার ঢাকা দক্ষিণ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের একাধিক বিষয়ে তৃতীয় শ্রেণি প্রাপ্ত। 

কানাইঘাট কলেজের অধ্যক্ষ ১২ বছর বয়সে দাখিল পাস করেছেন। পরিদর্শনের সময় পরিদর্শন টিমকে মূল কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। সে সময় পরিদর্শন টিম তাকে কাগজপত্র দেখানোর জন্য দুই মাস সময় দিয়েছিল। জামালপুর জেলার বঙ্গবন্ধু কলেজের অধ্যক্ষ তৃতীয় শ্রেণিতে ডিগ্রি পাসসহ মাস্টার্স পাস। আর নিয়োগ পরীক্ষার সময় প্রার্থী হিসেবে অভিজ্ঞতার ঘাটতি ছিল ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা কলেজের উপাধ্যক্ষের। 

মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ তৃতীয় শ্রেণিতে অনার্স পাস। ময়মনসিংহ জেলার বঙ্গবন্ধু কলেজের অধ্যক্ষ একাধিক তৃতীয় বিভাগসহ পাস কোর্সে মাস্টার্স পাস করেছেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033109188079834