সহ-স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে রশি টানাটানি থামছে না। নার্সিং ও সহযোগী শিক্ষা কার্যক্রম কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে তা নিয়ে বিরোধ এখন চরমে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ‘ওয়ান আমব্রেলা কনসেপ্ট’ বাস্তবায়নের বিষয়টিও উপেক্ষিত। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নার্সিং ও মেডিকেল টেকনোলজিসহ সহ-স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রমের শিক্ষার্থীরা। রোববার (১৭ নভেম্বর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জটিলতা নিরসনে ৪ নভেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন সচিবের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব উম্মে কুলসুম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়- অ্যালোকেশন অব বিজনেস অনুযায়ী ‘নার্সিং ও সহযোগী শিক্ষা কার্যক্রম’ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ডিপ্লোমা-ইন-মেডিকেল টেকনোলজি এবং ডিপ্লোমা-ইন-পোশেন্ট কেয়ার টেকনোলজি কোর্স চালু হওয়ায় একাধিক মামলা হয়েছে।
এতে নার্সিং ও সহযোগী চিকিৎসা শিক্ষা কার্যক্রমে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এ শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ সংকট নিরসনে এর আগে ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রী তখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় বিষয়টি নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ শাখা থেকে একটি নোটিশ দেয়া হয়েছে। ১২ নভেম্বর উপসচিব মো. আবদুর রউফ মিয়া স্বাক্ষরিত নোটিশে বলা হয়- নার্সিং, মেডিকেল টেকনোলজিসহ সহযোগী স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে উদ্ভূত সংকট নিরসনে জনপ্রশাসন সচিবের সভাপতিত্বে রোববার এক সভা অনুষ্ঠিত হবে।
সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী ‘ওয়ান আমব্রেলা কনসেপ্ট’ বাস্তবায়ন না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননা মামলা করা হবে না- এ মর্মে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। ২৩ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মো. হেলাল আমিন এ লিগ্যাল নোটিশ পাঠান।
জানা গেছে, ২০১৩ সালে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগে স্বাস্থ্য অধিদফতর একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেই বিজ্ঞপ্তিতে চাকরির যোগ্যতা হিসেবে রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ থেকে তিন বছরের ডিপ্লোমা থাকার বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়। এ বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থী এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের পক্ষ থেকে রিট করা হয়। এ নিয়োগ কার্যক্রমে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পাস করা শিক্ষার্থীরা যাতে অংশগ্রহণ করতে পারেন সেজন্য রিটটি করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে করা রিট মামলার বিপরীতে তৃতীয় পক্ষ হয়ে রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ থেকে ডিপ্লোমা করা শেখ মো. সাদি, শফিকুল ইসলামসহ চারজন মামলা পরিচালনায় অংশ নেন। মামলাটি দীর্ঘদিন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকার পর আদালত কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে পাস শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে নির্দেশ দেন। এরপর তৃতীয় পক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে। ২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর আপিল বিভাগের আদেশে ‘কারগরি বোর্ড থেকে পাসকৃতরা স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন’ উচ্চ আদালতের রায়ের এ অংশটি বহাল রাখেন। পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ‘ওয়ান আমব্রেলা কনসেপ্ট’ এবং এ সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশ যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু বিষয়টি বাস্তবায়ন না করেই স্বাস্থ্য অধিদফতর এ সংক্রান্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, নতুন নিয়োগ বিধি এবং আদালতের নির্দেশনা অনুসারে যাদের নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবে; তাদেরই নিয়োগ দেয়া হবে। এছাড়া আদালতের নির্দেশনা আমরা মেনে চলব।
জানা গেছে, সর্বস্তরে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে প্রতি বছর প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স নিয়োগ দেয়া হলেও প্রায় ১০ বছর ধরে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ হেলথ বুলেটিন-২০১৭-এর তথ্য অনুসারে বিভিন্ন পর্যায়ের হাসপাতালে ফার্মাসিস্টদের অনুমোদিত পদ রয়েছে দুই হাজার ৮৯৫টি। এর মধ্যে এক হাজার ২৮৬টি শূন্য রয়েছে। ল্যাবরেটরি টেকনোলজিস্টের ২১৬৭টি পদের মধ্যে ৭৪০টি শূন্য রয়েছে। একইভাবে রেডিও গ্রাফারের ৭৭৭টি পদের মধ্যে ১৯২টি, রেডিও থেরাপিস্টের ৮০টি পদের মধ্যে ৪২টি, ফিজিও থেরাপিস্টের ২৯৬টি পদের মধ্যে ১৮৮টি শূন্য রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী, চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য একজন চিকিৎসকের বিপরীতে পাঁচজন টেকনোলজিস্ট থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ২০০৭ সালের আন্তঃমন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে চারজন চিকিৎসকের বিপরীতে একজনেরও কম টেকনোলজিস্ট রয়েছেন। প্রতিবেদনে দেখা যায়- ২০০৬ সালে দেশে প্রতি ১৩ হাজার ৩১১ জন মানুষের জন্য টেকনোলজিস্ট ছিল মাত্র একজন। আর মোট টেকনোলজিস্টের সংখ্যা ১০ হাজার ৬৫৩ জন। বাংলাদেশ সোসাইটি অব রেডিও থেরাপি টেকনোলজিস্টের সভাপতি মামুনুর রশীদ বলেন, রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের বাইরে থেকে যারা নিজেদের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হিসেবে দাবি করছেন, তাদের হাতে সঠিক রোগ নির্ণয় সম্ভব নয়। তাদের নিয়োগ দেয়া হলে রোগীরা নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হবেন।